7/31/2024

হাতি হত্যা কি বন্ধ করা যাবে না

 হাতি হত্যা কি বন্ধ করা যাবে না

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র




শে যে হাতিটি দেখা যায়, এটিকে এশিয়ান এলিফ্যান্ট বা এশীয় হাতি বলে। এই এশীয় হাতি ১৩টি দেশে দেখা যায়। বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০০৪ সাল থেকে পরবর্তী ১৭ বছরে বাংলাদেশে হাতি হত্যা করা হয়েছে ১১৮টি। আরেকটি তথ্য অনুযায়ী হাতি-মানব দ্বন্দ্বে ২৩৬ জন মানুষ মারা গেছে।


আইইউসিএন-এর তথ্য অনুয়ায়ী বাংলাদেশে তিন ধরনের হাতি দেখা যায়। কিছু হাতি তাদের আবাসস্থলে বাস করে। কিছু হাতি পরিব্রাজন করে। কিছু হাতি পোষ মানা।

বন্য হাতি যারা, তারা তাদের আবাসস্থলে বাস করে, তাদের সংখ্যা ২৬৮। পরিব্রাজনকারী হাতির সংখ্যা ৯৩। পোষ মানা হাতির সংখ্যা ৯৬। বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত পাঁচ শর মতো হাতি ছিল।


সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী এই হাতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২৮ থেকে ৩২৭-এ। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা ২৬৩টি, যার ৫৫ ভাগই কক্সবাজার এলাকার। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ছাড়াও মানব-হাতি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে শেরপুর, জামালপুর ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গায়। 

প্রতিবছর শ্রীলঙ্কায় ২০০ হাতি হত্যা হয়। ভারতে মানুষ-হাতি সংঘর্ষে মারা পড়ে বছরে ১০০ হাতি।

কেনিয়ায়ও এই সংখ্যা বছরে ১২০-এর বেশি। ডাব্লিউডাব্লিউএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী মানুষ-বন্য প্রাণী দ্বন্দ্ব পৃথিবীর অনেক প্রজাতির প্রাণীর টিকে থাকার জন্য এখন হুমকিস্বরূপ। একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী এসবের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে বন্য বিড়াল প্রজাতির ওপর। এদের ওপর প্রভাব ৭৫ শতাংশেরও বেশি। এ ছাড়া সামুদ্রিক মাংসাশী প্রাণী এবং হাতির ওপরও এসবের ক্ষতিকারক প্রভাব বেশ দেখা যাচ্ছে।


বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১২টি হাতি চলাচলের জায়গা রয়েছে। কিন্তু এই রাস্তাগুলো হাতি চলাচলের উপযুক্ত নয়। হাতি বেঁচে থাকার জন্য এই পরিব্রাজনের রাস্তাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দিন দিন এসব জায়গা সংকুচিত হচ্ছে।

অনেক দেশেই হাতির বিচরণক্ষেত্রে মানুষ বসবাস করে। তাদের বন্য প্রাণীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয় জমি, খাদ্য, পানি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে। এসব মানুষ হাতির বিচরণ এলাকা কতটুকু বা অন্যান্য বন্য প্রাণী কোথায় বিচরণ করে এসব নিয়ে অসচেতন। ক্রমেই হাতি বসবাসের এলাকায় নতুন গ্রাম, খামার, শহর, বড় রাস্তা, শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে। হাতির যাতায়াতের পথে বেড়া দেওয়া হচ্ছে। বনভূমি কৃষিভূমিতে পরিণত হচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। হাতিরা নতুন নতুন এলাকায় ঢুকে পড়ছে এ কারণে। পানি ও জ্বালানি সংগ্রহ করতে গিয়ে মানুষ বড় বড় বিপদের মুখে পড়ছে। হাতি তৃণভোজী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাণী। এটি দিনে ১৫০ কিলোগ্রাম ঘাস এবং ১৯০ লিটার পানি পান করে। এ জন্য তাকে খাদ্য ও পানীয়ের জন্য বড় একটা এলাকা ঘুরে বেড়াতে হয়। একটি বড় পুরুষ হাতি ওজনে ছয় হাজার ৮০০ কিলোগ্রাম হয়, যা অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের থেকে ১০০ গুণ বেশি ভারী। যখন হাতি নিজে হুমকির মুখে পড়েছে মনে করে তখন সে মানুষকে আঘাত বা হত্যা করে, ঘরবাড়ি ও সম্পদ বিনষ্ট করে। হাতির কবলে পড়ে অনেক কিছুরই ক্ষতি হয়ে থাকে। ভারতেই প্রতিবছর হাতির কারণে পাঁচ লাখ পরিবারের শস্যের ক্ষতি হয়। ফলে এসব পরিবার প্রচণ্ড আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে এবং স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অভাবে পড়ে।


২০২১ সালে দেওয়া আইইউসিএন-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আগের ১৭ বছরে ৯০টি হাতি হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালে হত্যা করা হয় ১১টি হাতি। কোনোভাবেই এই হত্যা কমানো যাচ্ছে না। যদিও বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইন অনুযায়ী হাতি হত্যাকারীর শাস্তি দুই থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড। তবে আত্মরক্ষার্থে হত্যার ক্ষেত্রে এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু এসব বিধান প্রতিপালনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। সম্প্রতি এক সেমিনারে বাংলাদেশে নভেম্বর মাসেই চট্টগ্রাম ও শেরপুরে আটটি হাতি হত্যা করা হয় বলে জানা যায়। এগুলো হয় বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে, না হয় দুর্বৃত্তদের গুলিতে মারা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে হাতি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হতে বাধ্য। তাই এই মুহূর্তে হাতি হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক 

https://www.kalerkantho.com/online/miscellaneous/2024/07/31/1410417


No comments:

Post a Comment