বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগ কতটুকু
- অ+
- অ-
- অ
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী দিন দিন বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও যেসব বন্য প্রাণী দেখা যেত সেসবের এখন দেখা মেলা দুষ্কর। আমাদের দাদা-দাদিরা গল্প করেন, কাঠবিড়ালির কথা, মেছোবাঘ-বাগডাসের কথা। এইসব বন্যপ্রাণী বাড়ির আশেপাশেও দেখা যেত। কিন্তু এসব এখন আমাদের কাছে গল্প মনে হয়। সবচেয়ে মজার বিষয় অনেকে এমনও বলেন যে, এক সময় বাঘ দেখা মিলত গ্রামে। সেটা সত্যি বিশ্বাস করা আমাদের কাছে কষ্টকর হলেও কথাগুলো সত্যি। এই না দেখতে পাওয়ার মূল কারণ কী?
এটা অবশ্যই বিলুপ্তি। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। অনেক প্রজাতি বিলুপ্তি হয়ে গেছে এবং অনেক প্রজাতি বিলুপ্তি হওয়ার পথে। এ ব্যাপারে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর নেচার কনজারভেশনের ২০১৫ সালের প্রতিবেদন মতে বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা ৩১টি। ১৬০০ প্রাণী প্রজাতির মধ্যে ৩৯০টি হুমকির মধ্যে রয়েছে। আর ৫০টির বেশি প্রজাতি ঝুঁকিতে রয়েছে।
আইইউসিএনের ২০০০ সাল ও ২০১৫ সালের প্রতিবেদন তুলনা করলে দেখা যাবে, এই বিলুপ্তির হার অত্যধিক। ২০০০ সালে বিলুপ্ত প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা ছিল ১৩টি। অর্থাৎ ১৫ বছরে ১৮টি প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে যা ভয়াবহ বিলুপ্তির হারকে নির্দেশ করছে। বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রাণীদের মধ্যে রয়েছেÑডোরাকাটা হায়েনা, ধূসর নেকড়ে, নীল গাই, সুমাত্রা গণ্ডার, জাভা গণ্ডার, ভারতীয় গণ্ডার, শিঙা হরিণ, মন্তর ভালুক ইত্যাদি।
আইইউসিএন এর মহাবিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় আছে হাতি, ভোঁদড়, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, চিতা, বনরুই, উল্লুক, চশমা পরা হনুমান, বনগরু, সাম্বার হরিণ, কাঠবিড়ালি, কালো ভালুক প্রভৃতি। ২০১৫ সালের আইইউসিএনএর প্রতিবেদনে দেখানো হয়, বাংলাদেশের বনাঞ্চলে ২৮৬টি এবং সাফারি পার্কে ৯৬টি হাতি রয়েছে। বন্যপ্রাণী সংস্থাগুলোর মতে, বাংলাদেশে চিতাবাঘের সংখ্যা ৩০ থেকে ৫০টি। বাংলাদেশে ৩ হাজারের মতো উল্লুক ছিল। এটি নেমে হয়েছে ২০০ থেকে ৩০০টি। কিন্তু এত ভয়াবহভাবে এই প্রাণীগুলোর কমে যাওয়ার কারণ কী? বন্যপ্রাণী বিজ্ঞানীদের মতে, এর মূল কারণ আবাসস্থলের ধ্বংস। এছাড়া বনাঞ্চলের বড় বড় গাছ কেটে ফেলা, খাদ্য সংকট, পর্যটন, শিকার প্রভৃতি কারণে এদের সংখ্যা কমতে কমতে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্তির যে কারণগুলো দেখানো হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সমুদ্র থেকে অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, বন উজাড়করণ, আবাসস্থল ধ্বংস, দূষণ, আবহাওয়া পরিবর্তন, জিনগত বৈচিত্র্য কমে যাওয়া, খাদ্যাভাব, শিকার প্রভৃতি। বর্তমান পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ৫০ একর বাসস্থান ধ্বংস হচ্ছে। সমুদ্রে মৎস্য অতিরিক্ত আহরণের কারণে পৃথিবী থেকে প্রায় ৯০ প্রজাতি সামুদ্রিক মাছ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
বন উজাড়ের কারণে পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি প্রজাতি হুমকির সম্মুখীন। কৃষি ভূমির জন্য বন কাটা হচ্ছে। দেখা গেছে, আমাজন বনের দুই তৃতীয়াংশই কাটা হয়েছে কৃষি কাজের জন্য। দূষণের কারণে বিশ্বের প্রায় ৭০০ প্রজাতি সরাসরি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হচ্ছে দূষণ। আমেরিকার ৬৯ ভাগ প্রজাতি দূষণের শিকার।
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির অন্যতম কারণগুলো হলো- নগরায়ণ, আবহাওয়া পরিবর্তন, আবাসস্থল ধ্বংস, দূষণ, শিকার প্রভৃতি। একদিকে যেমন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে কৃষির জন্য বন উজাড় করা হচ্ছে। একদিকে যেমন হ্রাস পাচ্ছে নদীর নাব্য অন্যদিকে অজস্র প্রাণী শিকারে পরিণত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তাই এখন থেকেই দরকার যথাযথ পদক্ষেপ। বাংলাদেশে ইন-সিটু এবং এক্স সিটু উভয় পদ্ধতিতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হয়। ইন-সিটু পদ্ধতিতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ হচ্ছে মূল বাসস্থানে অর্থাৎ যে বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে জীব বড় হচ্ছে সেই বাস্তুতন্ত্রেই সংরক্ষণ করা। আর এক্স-সিটু সংরক্ষণ হচ্ছে মূল বাসস্থানের বাইরে উদ্ভিদ ও প্রাণীকে সংরক্ষণ করা।
ইন-সিটু পদ্ধতিতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রধান মাধ্যমগুলো হলো- জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, ইকোপার্ক, সাফারি পার্ক, অভয়ারণ্য, মৎস্য অভয়াশ্রম ইত্যাদি। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান রয়েছে। এগুলো হলো- ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান, মধুপুর জাতীয় উদ্যান, রামসাগর জাতীয় উদ্যান। চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজারে রয়েছে ইকোপার্ক। এছাড়া দুলাহাজরা ও শ্রীপুরে সাফারি পার্ক রয়েছে। বাংলাদেশে মৎস্য ও বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমও রয়েছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অভয়াশ্রম হলো- টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, হালদা নদী প্রভৃতি। এক্স-সিটু সংরক্ষণ পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে বোটানিক গার্ডেন, সীড ব্যাংক, জিন ব্যাংক, ডিএনএ ও পরাগরেণু সংরক্ষণ।
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ দূষণকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের অত্যাচারে এখন বনের পশুপাখিরাও টিকে থাকতে পারছে না। বন ধ্বংস তো হচ্ছেই, ভরাট হয়ে যাচ্ছে জলাশয়। অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার, আগাছা নাশক, কীটনাশক, ছত্রাক নাশক ব্যবহারের ফলে অনেক জলজ ও স্থলজ প্রজাতি আজ বিলুপ্তির পথে। এতে করে নির্দিষ্ট বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জলাভূমি ও বনভূমি উভয়ের হ্রাসের কারণে বহু প্রাণীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে।
এক সময় আমাদের পত্রঝরা বনগুলোতে ময়ূর দেখা মিলত, তা এখন কল্পনা। এই ৫০ বছর আগেও শালবনে বাঘ ছিল। এখন এসবের দেখা মেলে না। এতে করে পৃথিবীর আবহাওয়ায় পরিবর্তিত হচ্ছে। উষ্ণ হয়ে উঠছে চারপাশ। জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে আজ বাংলাদেশ। এজন্য সরকার ও জনগণ উভয় পক্ষকেই এক সাথে কাজ করতে হবে। কোনো একটি সংস্থা বা প্রশাসন এককভাবে এই কাজে সফল হতে পারবে না। সরকার, বন বিভাগ, এনজিও, স্থানীয় জনগণ সবাইকে নিয়ে একটি সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালিত হলেই অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত হওয়া যাবে। বনায়ন কর্মসূচির পাশাপাশি শিকার বন্ধ করতে হবে। গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় দরিদ্র মানুষদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। দূষণ বন্ধ করতে হবে। গাছপালা ও পশুপাখিদের আবাসস্থল ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আবহাওয়া পরিবর্তন রুখতে হবে। শুধু বিলুপ্তপ্রায় জীব নয়, সকল জীবের সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
মনে রাখতে হবে প্রতিটি জীবই বাস্তুতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর একটি বাদ পড়লে বাস্তুতন্ত্রেও ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে। একটি প্রজাতি বাঁচানো মানে শুধু সেই প্রজাতি নয়, পুরো বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচানো। সম্মিলিতভাবে জীবের বংশ বিস্তারে সহায়তা করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে প্রতিটি জীবের নিজস্ব পরিবেশ। তবেই বাংলাদেশ হবে সকল জীবের স্থায়ী আবাসস্থল।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক
No comments:
Post a Comment