3/19/2024

প্রাণী রক্ষায় প্রযুক্তি ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 



জীববৈচিত্র্য

প্রাণী রক্ষায় প্রযুক্তি

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৪ ১০:৪৭ এএম


ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

পৃথিবী নামক গ্রহে অসংখ্য বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণীর বসবাস। বৈশ্বিক পরিবেশ পরিবর্তন যেমন আবহাওয়া পরিবর্তন, বন হারিয়ে যাওয়া, ভূমির অপব্যবহার বন্য প্রাণী বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ১ হাজার ২১০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১ হাজার ৪৬৯ প্রজাতির পাখি, ২ হাজার ১০০ প্রজাতির সরীসৃপ ও ২ হাজার ৩৮৫ প্রজাতির মাছ হুমকির মুখে রয়েছে। বন্য প্রাণী পাচার, নানা রোগব্যাধির বিস্তার, আবহাওয়া পরিবর্তনে মানুষের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্য প্রাণীর বাসস্থান হুমকির মুখে নিয়ে যাচ্ছে। আজকালকার যুগকে মানুষের যুগ বলা হলেও এটি ধীরে ধীরে তথ্যের যুগে প্রবেশ করছে। মানুষ এখন ইন্টারনেট, সমাজমাধ্যম, কম্পিউটার ডিভাইস ব্যবহার করে জীবন সহজ ও যুক্ত করে তুলছে। ইন্টারনেট মানুষকে প্রাকৃতিক পৃথিবী নতুন করে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের আলাদা সুযোগ করে দিয়েছে। উন্নত সেন্সর ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা খুব দ্রুত তথ্য পেতে ও বিশ্লেষণ করতে পারছেন। পৃথিবী মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের কারণে এখন হুমকির মুখে। ইন্টারনেটের বিকাশ মানুষকে একটা সুযোগ করে দিচ্ছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার। বন্য প্রাণী সংরক্ষণে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন কীভাবে বন্য প্রাণী সংরক্ষণকে আরও সহায়তা করে, মানুষ ও বন্য প্রাণীর সহাবস্থান নিশ্চিত করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও সংরক্ষণে যুক্ত করে তা নিয়ে এখন ভাবা হচ্ছে।




সাম্প্রতিক গবেষণামতে বিশ্বের ৩৭ দেশে ২৪৮ জন সংরক্ষণবিদ ১১ ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন। যেমন ক্যামেরা, ব্লগ, রিমোট যন্ত্র ইত্যাদি। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ৮.৭ মিলিয়ন প্রজাতি আবিষ্কার হয়েছে। এসবের মধ্যে মাত্র ৮৬ ভাগ প্রজাতি ভূপৃষ্ঠে এবং ৯১ ভাগ প্রজাতি সমুদ্রে রয়েছে। অধিকাংশ গবেষণার প্রস্তাব হচ্ছে সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়া হলে এ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই অর্ধেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। ক্যামেরা ব্যবহার করে আমরা প্রজাতি শনাক্ত ও গণনা করতে পারি। এখন ডিজিটাল ক্যামেরায় সেন্সরের মাধ্যমে ছবি গ্রহণ করা যায়। সেন্সর ব্যবহার করে প্রাণীর ভিডিও ধারণের মাধ্যমেও শনাক্ত ও গণনা করা সম্ভব। এতে দ্রুত ও সহজেই পশুপাখি গণনা ও শনাক্ত করা সম্ভব। এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের অনেক তথ্য থাকলে তা বিশ্লেষণ করা যায়। ক্যামেরা, স্যাটেলাইট, ড্রোনের সংগ্রহ করা অসংখ্য ছবি বা ভিডিও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে সহজেই বিশ্লেষণ করা সম্ভব। জীববিজ্ঞানী ও সফ্ট্ওয়্যার প্রকৌশলীরা একটা এআই পদ্ধতি উন্নয়ন করতে যাচ্ছেন; যেখানে প্রাণীর ছবি ব্যবহার করলে তা সহজেই শনাক্ত করা যাবে। জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণে এখন পরিবেশ ডিএনএ বলে একটি বিষয় ব্যবহার করা হয়।

পরিবেশ ডিএনএ পদ্ধতি ব্যবহার করে আবহাওয়ার পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া পশুপাখির ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে কি না বা পরিবেশগত কোনো ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে কি না তা সহজেই বোঝা যাবে। এটি দ্বারা কোনো এলাকা রক্ষা করা সম্ভব। ক্যামেরা, বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এসব অনলাইনে যুক্ত করে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে প্রাণীর আচরণ ও কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতি আছে কি না জানা যাবে। এর মাধ্যমে বন্য প্রাণীর ঘনত্ব শুধু নয়, বন্য প্রাণী গণনাও করা সম্ভব। ক্যামেরায় রিমোট ডিভাইস যুক্ত করে সেন্সরের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় ছবি ও ভিডিও ধারণ করার মাধ্যমে বন্য প্রাণীর ওপর নজর রাখা হচ্ছে। এটি এখন গুরুত্বপূর্ণ বন্য প্রাণী গবেষণা যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও সরকার আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা, বিভিন্ন বিশ্ব সংগঠন একত্রে এ পরিবেশ মোকাবিলা নিয়ে কাজ করছে। প্রযুক্তি বিশ্লেষণ সহজ করে তুলছে। অনেক বাধা ও শক্ত আইন থাকার কারণে জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ খুব একটা সহজ হচ্ছে না। বিভিন্ন দেশ জাতীয় উদ্যানে ও বন্য প্রাণী অভয়াশ্রমে অনেক শক্তিশালী আইন জারি রেখেছে। ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেসব অঞ্চলে পশুপাখি পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে। পশুপাখির আচরণ, কার্যক্রম এবং বাসস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য জিপিএস ব্যবহার করা হয়। জিপিএস ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যগত সমস্যা, আচরণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে সংরক্ষ্যণ ও বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখা যায়।




আমরা এখন ডিজিটাল বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছি। মানবকেন্দ্রিক উন্নয়নে ডিজিটাল সরকারব্যবস্থা আরেকটা স্তর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ২.৭ বিলিয়ন মানুষ এখনও ইন্টারনেট ব্যবহার করে না। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মাত্র ৩৬ ভাগ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবই সামনে আনছে না, বন্য প্রাণী বেচাকেনা বন্ধেও বেশ ভূমিকা রাখছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ডিজিটাল প্রযুক্তির একটি সেতুবন্ধ রচনা করা দরকার। বন্য প্রাণী ও বাস্তুতন্ত্র দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে। এর সুরক্ষায় মানুষকে যুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে বনের আশপাশের মানুষ বা ওই বাস্তুতন্ত্রের মানুষকে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সংশ্লিষ্ট করতে হবে। এজন্য দরকার ডিজিটাল প্রযুক্তি তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করা। মোবাইল একটি গুরুত্বপূর্ণ ডিভাইস। ডিজিটাল প্রযুক্তি বিকাশের লক্ষ্যে মোবাইল বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে অনেক মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক বনাঞ্চলগুলোয় পাওয়া যায় না। এটি ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে একটা বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।

বাংলাদেশে বন্য প্রাণী ধরা, মারা, বেচাকেনা বন্ধে দুয়েকটি ফেসবুক গ্রুপ দেখেছি। এ ছাড়া এনজিওগুলো বন্য প্রাণী পাচার ও বেচাকেনা বন্ধে অ্যাপস ব্যবহারের কথা ভাবছে। পৃথিবীর অনেক দেশই বন্য প্রাণী সংরক্ষণে ডিজিটাল প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করছে। ইন্দোনেশিয়া, উগান্ডার মতো দেশগুলো জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রযুক্তির ব্যবহার করে বেশ সুফল পেয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবসা বন্ধে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। মানব ও বন্য প্রাণীর সহাবস্থান এবং বর্তমানে ও ভবিষ্যতে এ সহাবস্থান উন্নয়নে প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করবে এ নিয়ে ভাবা হচ্ছে। মানুষ যত যুক্ত হবে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি তত সহজ হবে। সব বয়সে, সব লিঙ্গের বিশেষ করে স্থানীয় জনগণকে প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। সরকার, এনজিও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাইকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। তা হলেই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা যাবে।

No comments:

Post a Comment