6/09/2024

প্রয়োজন পরিকল্পিত সামাজিক বনায়ন ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 



প্রয়োজন পরিকল্পিত সামাজিক বনায়ন

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 আপডেট : ০১ জুন ২০২৪, ০৭:৪১ এএম|প্রিন্ট সংস্করণ



সারা বিশ্বেই বনের আশপাশের স্থানীয় জনগণ বনকে যেমন ব্যবহার করে, তেমনি রক্ষণাবেক্ষণও করে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় প্রায় ১৪০ মিলিয়ন মানুষ বনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। সামাজিক বনায়ন একটি বিকল্প বন ব্যবস্থাপনা। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ বনে বাস করে এবং একই সঙ্গে বনকে ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। এর মাধ্যমে তাদের অধিকার ও স্থানীয় জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য যেমন দূর করা হয়, তেমনি স্থানীয় অধিবাসীদের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন করা হয়। এটি খুব সহজেই কম খরচের মাধ্যমে করা যায়।

বাংলাদেশ বন ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশটিতে ২.১৬ মিলিয়ন বন রয়েছে, যা প্রায় ১৪ শতাংশ। অনেকের তথ্যমতে, অনেক জেলায় বনের তথ্য নেই। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালে বন হ্রাসের হার ছিল ২.১ শতাংশ, ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালে এটি কমে হয়েছে ০.২ শতাংশ। তারপরও বন হ্রাসের বৈশ্বিক হার (০.১ শতাংশ) থেকে বেশি। বন হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য, জ্বালানি কাঠের চাহিদা, কৃষিভূমির অপ্রতুলতা, শিল্পায়ন প্রভৃতি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালে সামাজিক বনায়নের কর্মসূচি নেওয়া হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি। একটি স্থানীয় জনগণকে বন সংরক্ষণে অংশগ্রহণ করানো। আরেকটি হলো দরিদ্র মানুষের আর্থসামাজিক জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো।

তবে এ চিত্রটি খুব একটা সুবিধাজনক নয়। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেনি। আবার বিভিন্ন সংগঠন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থও হয়েছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে বন বলতে ম্যানগ্রোভ, পাহাড়ি ও শাল বন রয়েছে। ২৮ জেলায় কোনো জাতীয় বন নেই। সামাজিক বনায়নের কারণে এখন অবশ্য প্রায় সব জেলায়ই কিছু না কিছু বন রয়েছে। এর মধ্যে প্রাকৃতিক বন রয়েছে ৮৩ শতাংশ।

১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ আমল এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান আমলে বন থেকে কাঁচামাল শিল্পকারখানায় দেওয়া হতো। ১৯৭৯ সালে জাতীয় বন নীতিমালা করা হয়। পরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সামনে রেখে নীতিমালা সংশোধন করা হয়। কৃষি বনায়ন শুরু হয় আসলে ১৮৭৩ সালে। বন বিভাগ তখন পাহাড়ি এলাকায় টিক বনায়ন শুরু করে। প্রায় ১০০ বছর পর ১৯৬০ সালে বন বিভাগ সারা দেশে বন সম্প্রসারণ কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৮২ সালে বন বিভাগ অংশগ্রহণমূলক সামাজিক বনায়ন শুরু করে। এডিবির সহায়তায় উত্তরাঞ্চলে সাতটি জেলায় এটি শুরু করা হয়। বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ১৯৮৮ সালে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি শুরু করা হয়। অবশ্য সে সময় পাহাড়ি তিনটি এ প্রকল্পের আওতায় ছিল না।

সামাজিক বনায়নের উদ্দেশ্য ছিল কাঠ ও জ্বালানি কাঠের চাহিদা মেটানো, দরিদ্র জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, কর্মসৃজন, বন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বন বিভাগ ৪৪ হাজার ৪০৮ হেক্টর উডলট, ১০ হাজার ৬২৬ হেক্টর কৃষি বন, ৬১ হাজার ৭৩৯ হেক্টর স্ট্রিপ চাষ করেছে।

সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে কৃষি বনায়নের মাধ্যমে খুব সহজেই স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা যায়। এর মাধ্যমে ভূমি সংকোচন কমে। কৃষি বনায়নের ফলে বন সংকোচন বন্ধ হয়। এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণে নানা চাহিদা পূরণ করা যায়। এর মাধ্যমে স্থানীয়রা অর্থনৈতিক সুবিধা পায়। ভূমিহীন মানুষ, বিধবা নারী, বেকার যুবক ও অন্যান্য দরিদ্র মানুষকে কৃষি বনায়নের সঙ্গে যুক্ত করে বন ও জীবনমানের উন্নতি করা যায়। সামাজিক বনায়নে সম্পৃক্ত মানুষ এখন ৭৫ শতাংশ লভ্যাংশ পায়, আগে এটি ছিল ৪৫ শতাংশ।

কৃষি বনায়ন বাংলাদেশে জনপ্রিয় হলেও এখানে অনেক অব্যবস্থাপনা রয়েছে। যেমন, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় আগেভাগেই গাছ কেটে ফেলা হয়। বন বিভাগ কৃষি বন, উডলট বন, বাড়ির পাশে কৃষি বনায়ন, বৃক্ষরোপণ, স্ট্রিপ চাষ, বাঁশ চাষ, হোগলা চাষ, আগার চাষ, মৌ চাষ, রেশম চাষ প্রভৃতি কর্মসূচি শুরু করে। বন বিভাগ অংশগ্রহণমূলক বনায়ন, গ্রামীণ বনায়ন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে নার্সারি প্রতিষ্ঠা, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বনায়ন, জুম চাষের মাধ্যমে বনায়ন, সামাজিক বনায়নের প্রশিক্ষণ প্রভৃতি কাজ করে। বাংলাদেশে কৃষি বনায়ন দীর্ঘদিন ধরে চললেও এর বেশ কিছু বাধা রয়েছে। প্রথম বাধাটি ভূমিকেন্দ্রিক। এ ছাড়া এসব প্রকল্পের যথাযথ পর্যবেক্ষণ করা হয় না। উৎপাদিত বস্তুর বাজারজাতকরণ ঠিকমতো হয় না। প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাব। অপ্রতুল গবেষণা। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার অভাব। কৃষি বনায়নে তথ্যের ঘাটতি।

কৃষি বনায়নে উপযুক্ত গাছ হলো খেজুর, কাঁঠাল, তাল, আম, নারিকেল, সুপারি, লিচু, বাঁশ প্রভৃতি। কিন্তু এসব উপযুক্ত স্থানীয় জাতের গাছ না রেখে উডলট, ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি নানা রকমের গাছ রোপণ করা হয়। দেশি গাছ থাকলে সেখান থেকে ওষুধ তৈরি করা যাবে। পশুপাখি তাদের খাবার পাবে। বাস্তুসংস্থান ঠিক থাকবে। ভেষজ ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ওষুধ তৈরির কাঁচামাল খুঁজে পাবে সহজেই। এসব গাছ থাকলে পুষ্টি ঘাটতি যেমন পূরণ হবে, তেমনি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার কাজগুলোও করা যাবে। মাটি, বাতাস সর্বোপরি পরিবেশ সুরক্ষিত থাকবে। বাংলাদেশে আশির দশকে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, পাইন এসব বিদেশি গাছ প্রবেশ করে। সে সময় এসব গাছের চারা বিনামূল্যেও বিতরণ করা হতো। পরে অবশ্য ২০০৮ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এর চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। বন বিভাগও এর উৎপাদন বন্ধ করে।

এ দেশে ইউক্যালিপটাস জনপ্রিয় হওয়ার কারণ এটি দ্রুত বাড়ে। তেমন একটা যত্ন লাগে না। চারা রোপণ করলে ছাগল-গরু এসবের পাতা খায় না। চাষ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। এসব বিদেশি গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় জ্বালানিতে অবদান রাখলেও এর ফলে একটা পরিবেশের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে। এটি মাটি থেকে বেশি পরিমাণ পুষ্টি ও পানি শোষণ করায় এর আশপাশের স্থানীয় জাতের গাছ এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছে কোনো পাখি বাসা বাঁধে না। এর নিচে যেমন বিশ্রাম নেওয়া যায় না, তেমনি এর কাণ্ড পাতায় কোনো অণুজীবও জন্মায় না। কাজেই সামাজিক বনায়নের আওতায় কোন গাছগুলো রোপণ করতে হবে, এ নিয়ে আরও সতর্কতা জরুরি। কোন অঞ্চলে কী ধরনের গাছ রোপণে স্থানীয়রা আগ্রহী ও লাভবান হবে, তার প্রতি খেয়াল রেখে সামাজিক বনায়নের পরিকল্পনা করা জরুরি।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

https://www.kalbela.com/ajkerpatrika/joto-mot-toto-path/92846



 


No comments:

Post a Comment