7/10/2024

গাছের শত্রু-মিত্র ও বিদেশি প্রজাতি ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র



পরিবেশ-প্রতিবেশ

গাছের শত্রু-মিত্র ও বিদেশি প্রজাতি

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৪ ০৯:৫৩ এএম

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

‘অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান/ প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদি প্রাণ,/ ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা/ ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ-পরে; আনিলে বেদনা/ নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা বৃক্ষবন্দনার প্রথম দিকের কটি লাইন। শেষদিকটা এমন, ‘তব তেজে তেজীয়মান,/ সজ্জিত তোমার মাল্যে যে মানব, তারি দূত হয়ে/ ওগো মানবের বন্ধু, আজি এই কাব্য-অর্ঘ্য লয়ে/ শ্যামের বাঁশির তানে মুগ্ধ কবি আমি/ অর্পিলাম তোমায় প্রণামী’। 

 গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ”র খবর পড়তে ফলো করুন

পৃথিবীর একমাত্র অকৃত্রিম বন্ধু বোধ হয় গাছ। মানুষেরও বন্ধু। তবে গাছেদেরও টিকে থাকতে হয়। প্রতিযোগিতা হয়। এই প্রতিযোগিতায় কোনো গাছ টিকে থাকে। কেউ হারিয়ে যায়। পৃথিবীমাতার সন্তান হয়ে মানুষেরও দায়িত্ব নিতে হয়। মানুষ যেমন বৃক্ষ কর্তন করে, তেমনি বৃক্ষ রোপণও করতে হয়। প্রয়োজন হয় বনায়নের। বাংলাদেশে বনায়ন হয়। কিন্তু কখনও কখনও দেখা যায়, যে গাছ দিয়ে বনায়ন করা হয়Ñ সেই গাছই বনের জন্য শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। কেননা সেই গাছ এতটাই আগ্রাসী যে ওই গাছের কারণে দেশীয় প্রজাতির নানা ভেষজ ও প্রাকৃতিক গাছ বিলুপ্ত হয়ে যায়। দেশীয় গাছের বদলে জায়গা করে নিচ্ছে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণিসহ নানা জাতের বিদেশি গাছ। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি প্রভৃতি গাছের কারণে পশুপাখিদের খাদ্যশৃঙ্খলা ব্যাহত হয়। বন্য প্রাণীর জন্য তা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে। রোগবালাইয়ের কারণ হয়। এসব গাছের পানি শোষণ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় এর নিচে ঘাসজাতীয় গাছ হয় না। এতে করে বাস্তুতন্ত্রের একটি বড়সংখ্যক প্রজাতি বিলুপ্তির দিকে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

দেশি গাছ থাকলে সেখান থেকে ওষুধ তৈরি করা যাবে। পশুপাখি তাদের খাবার পাবে। বাস্তুসংস্থান ঠিক থাকবে। ভেষজ ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ওষুধ তৈরির কাঁচামাল খুঁজে পাবে সহজেই। এসব গাছ থাকলে পুষ্টিঘাটতি যেমন পূরণ হবে, তেমনি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার কাজগুলোও করা যাবে। মাটি, বাতাস সর্বোপরি পরিবেশ সুরক্ষিত থাকবে। বাংলাদেশে আশির দশকে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, পাইন এসব বিদেশি গাছ প্রবেশ করে। সে সময় এসব গাছের চারা বিনামূল্যেও বিতরণ করা হতো। পরে অবশ্য ২০০৮ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এর চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। বন বিভাগও এর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।

এ দেশে ইউক্যালিপটাস জনপ্রিয় হওয়ার কারণ এটি দ্রুত বাড়ে। তেমন একটা যত্ন লাগে না। চারা রোপণ করলে ছাগল-গরু এসবের পাতা খায় না। চাষ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। এসব বিদেশি গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় জ্বালানিতে অবদান রাখলেও এর ফলে একটা পরিবেশের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে। এটি মাটি থেকে বেশি পরিমাণ পুষ্টি ও পানি শোষণ করায় এর আশপাশের স্থানীয় জাতের গাছ এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছে কোনো পাখি বাসা বাঁধে না। এর নিচে যেমন বিশ্রাম নেওয়া যায় না, তেমনি এর কাণ্ড পাতায় কোনো অণুজীবও জন্মায় না। একটি বাস্তুতন্ত্রে প্রবেশকারী নতুন প্রজাতি এলিয়েন স্পেসিস বলে। এসব এলিয়েন স্পেসিসের কারণে স্থানীয় প্রজাতি ধ্বংসের মুখে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে কোনো প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণের মধ্যে একটি হলো সেই এলাকায় এলিয়েন স্পেসিস বা প্রজাতির প্রবেশ। যেসব প্রজাতি ভিন্ন বা নতুন বাস্তুতন্ত্রে প্রবেশ করে স্থানীয় প্রজাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তাদের আগ্রাসী এলিয়েন স্পেসিস বলে।

একটি গবেষণার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আর আহমেদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের এম কে হোসেনের গবেষণা। তারা দুজনে পরিবেশের ওপর ইউক্যালিপটাসের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পান ইউক্যালিপটাস লাগানোর ফলে মাটির উর্বরতা ১৫ শতাংশ কমে যায়। মাটির পানি দ্রুত শুষে নেয়। বাষ্পীভবনের হার বেশি এবং ৯২ ভাগ মানুষ এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবগত নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি গাছের সঙ্গে দেশি গাছ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। এমনিক এদের বংশ বৃদ্ধিও বন্ধ হয়ে যায়। উপকারী কীটপতঙ্গ মারা পড়ে। উত্তরাঞ্চলে হাটবাজারে বিক্রি হওয়া গাছের চারার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি। জমির আইলে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগালে ফসলে পানির অভাব হয়। একটি তথ্যমতে, ইথিওপিয়ায় ভুট্টাক্ষেতের পাশে ইউক্যালিপটাসগাছ লাগানোর ফলে হেক্টরপ্রতি ফলন ৪ দশমিক ৯ থেকে ১৩ দশমিক ৫ টন হ্রাস পায়। পাকিস্তানের একটি গ্রামে ১৯৯৫ সালে ইউক্যালিপটাসগাছ লাগানো হয়। ২০০০ সালে সেই গ্রামের পানির স্তর ২ ইঞ্চি কমে যায়। ইউক্যালিপটাসের ক্ষতি বুঝতে পেরে কেনিয়াতে এর রোপণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

বাংলাদেশে এলিয়েন প্রজাতি হিসেবে রয়েছে- কচুরিপানা, পার্থেনিয়াম, লজ্জাবতী, আসামলতা, স্বর্ণলতা, ঢোলকলমি। বাংলাদেশে এ রকম ১৫টি আগ্রাসী এলিয়েন স্পেসিস শনাক্ত করেছে ন্যাশনাল বায়োডাইভারসিটি স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান। এলিয়েন স্পেসিসকে আগ্রাসী ও ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে ন্যাশনাল বায়োডাইভারসিটি স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যানে। বিদেশি গাছ এখানে নানাভাবে প্রবেশ করেছে। তবে অধিকাংশ প্রজাতি মানুষের মাধ্যমেই ছড়িয়েছে। রেইনট্রি, সেগুন, আকাশমণি, আকাশি, শিশু, বাবলা, ইউক্যালিপটাস এসব নানা জাতের বিদেশি গাছের আশ্রয় এখন বাংলাদেশ। বাংলাদেশে রেইনট্রি, মেহগনি, চাম্বল প্রভৃতি গাছ প্রবেশ করে ব্রিটিশ আমলে। আকাশমণি, শিশু, ইপিলইপিল, বাবলা, ইউক্যালিপটাস এবং খয়েরজাতীয় গাছ প্রবেশ করে আশির দশকে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রবেশ করেছে কচুরিপানা, পার্থোনিয়াম, স্বর্ণলতা, মটমটিয়া, রিফুজিলতা ইত্যাদি। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব বিদেশি গাছের কারণে বাংলাদেশে ৫ হাজার প্রজাতির দেশি গাছ থাকলেও এটি এখন কমে ৩ হাজার ৮২৮ প্রজাতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এই ক্ষেত্রে বিদেশি গাছ আমদানি করতে একটা নীতিমালা দরকার। কোন গাছ আনা যাবে, আর কোনটি আনা যাবে না, তা বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। ক্ষতিকর বিদেশি গাছ শনাক্ত করে সারা দেশে তা কর্তনের ব্যবস্থা করতে হবে। বন বিভাগকে বিদেশি জাতের উদ্ভিদ না দিয়ে দেশি জাতের চারা বিতরণ করতে হবে। তাহলেই হারিয়ে যাওয়া প্রজাতি হয়তো আবার দেখা দেবে। পশুপাখিরা পাবে তাদের খাবার আর আশ্রয়স্থল।

No comments:

Post a Comment