7/10/2024

শান্তির বসবাস ফিরিয়ে দিতে পারে নগর-বন ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 



শান্তির বসবাস ফিরিয়ে দিতে পারে নগর-বন

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

নগর বা শহরের সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো জায়গায় যেকোনো ধরনের গাছ নিয়ে নগর-বন সৃষ্টি হয়। এটি হতে পারে রাস্তার দুই ধারে অথবা কোনো জলাশয়ের ধারে অথবা শহরের অন্য কোনো খালি জায়গায়। এর মাধ্যমে নগরে বা শহরে একটি সবুজ ঘন কাঠামো তৈরি হয়। নগরের বাস্তুতন্ত্রকে এটি বিস্তৃত ও সবুজ করে তোলে।

শহরের মানুষকে এটি নানাভাবে উপকারও করতে পারে। একটি ভালো ও বৈচিত্র্যময় নগর-বন শহরবাসীর নানা উপকারে আসে। নানা ধরনের নগর-বনের বনজ সম্পদ নানাভাবে মানুষকে উপকৃত করে। নগর-বন একটি ঘন সবুজ বনের কাঠামো দান করে।

এর মধ্যে ঘাস, ঘন ঝোপঝাড়ও রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা নগর-বনের গাছপালা শহরের মানুষের স্বাস্থ্যের নানা উপকারও করে। এটি যেমন তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, ঠিক তেমনি শব্দদূষণ, বন্যা ইত্যাদি থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে। এ ছাড়া বায়ুদূষণ কার্বনদূষণ প্রতিরোধে কাজ করতে পারে।এসব গাছের নানা রকমের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যমানও রয়েছে। 

নগর-বন নতুন কোনো ধারণা নয়। ১৯৯০ সালে কোরিয়ায় প্রথম নগর-বন ধারণাটি প্রতিষ্ঠা পায়। ২০১৩ সাল থেকে নগরকেন্দ্রিক বনায়ন আন্তর্জাতিকভাবে বন গবেষণায় একটি বড় ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে। সে সময় থেকেই জাতিসংঘ নগর বনায়নের গুরুত্ব তুলে ধরে এবং নগর পরিকল্পনায় এটি যোগ করার কথা বলে।

এমনকি ২০১৮ সালে নগর বনায়নের জন্য একটি বিশ্ব সংস্থা গঠিত হয়। সারা বিশ্বে তা গঠনের জন্য ঘোষণা দেওয়া হয়। সোসাইটি অব আমেরিকান ফরেস্টার্সের বন অভিধান অনুযায়ী, নগর বনায়নকে এমন একটি শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়, যেখানে শহর ও শহরের চারপাশে একটি বৃক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে। এমন একটি বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠবে, যা সমাজকে শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নান্দনিক  মূল্য দান করবে। নগর-বন বলতে শহর বা নগরের সব ধরনের সবুজ গাছপালা ও এর উপাদানকে বোঝাবে। নগরের বনজ সম্পকে নিয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা থাকবে। এ ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক ও অংশীদারের ভিত্তিতে নগরে বনায়ন করতে হবে, যা অর্থনীতি, পরিবেশ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটাবে।

নগরের মানুষের এখন একটি ভালো স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দরকার বেঁচে থাকার জন্য। বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ এমন এক পরিবেশে বসবাস করে, যেখানকার বাতাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রায় নেই। শুধু স্বাস্থ্যকর বাতাস পেলেই চলবে না, দরকার শীতল বাতাস। শহরে প্রচণ্ড মাত্রায় তাপ থাকে। বড় বড় দালানকোঠা থাকায় বায়ুপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। গাছপালা ছাড়া শহরের উত্তপ্ত হাওয়া আরো উত্তপ্ত হবে। এটি আরো দূষিত ও ক্ষতিকর হবে। এক যুক্তরাষ্ট্রে শহরে তাপপ্রবাহে প্রতিবছর এক হাজার ৩০০ মানুষ মারা যায় এবং সারা বিশ্বের হিসেবে এই সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরো বেশি হবে। নগরে থাকা একটি বড় ঘন গাছের স্তর প্রতিবছর ২২ পাউন্ড কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং এই পরিমাণ গাছের স্তর বছরে ছয় হাজার পাউন্ড অক্সিজেন তৈরি করে। এ ছাড়া এরূপ গাছপালা এক হাজার গ্যালন বৃষ্টির পানি শোষণ করতে পারে।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের তথ্য মতে, বিশ্বে দূষণের তালিকায় প্রায় শীর্ষে থাকে ঢাকা। ক্লিন এয়ার ফান্ডের তথ্য মতে, স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটি ফান্ডিং ২০২৩-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বায়ুর গুণগত মানোন্নয়নের তহবিলপ্রাপ্তিতে তৃতীয় ছিল বাংলাদেশ। এতে আরো বলা হয়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বায়ুর মানোন্নয়নে বায়লাদেশ ২.৪ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। আরো একটি তথ্য অনুযায়ী, শীতকালে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি এবং অস্বাস্থ্যকর হলেও বর্ষাকালে দূষণ একটু কম থাকে। বাংলাদেশের বায়ুদূষণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। দূষণ যেমন বাড়ছে, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুদূষণজনিত নানা রোগ। মানুষের গড় আয়ুও কমে যাচ্ছে। একদিকে যেমন নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ ও জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে দ্রুত; অন্যদিকে বাড়ছে  শ্বাসকষ্ট। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এই বায়ুদূষণ যেটি বাড়ছে, সেটি আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকছে না। দূষণ হয়ে যাচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি। এর প্রভাব পড়ছে বেশি।

সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ঢাকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও বায়ুদূষণ রোধে নগর-বন তৈরির পরিকল্পনা করেছে। এই নগর-বন তৈরি করতে পারলে এটিই হবে ঢাকায় প্রথম পরিকল্পিত বন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, নগর বনায়নের জন্য দুটি স্থানও নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি বনানীতে এবং আরেকটি কল্যাণপুরে। জায়গাগুলো সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের। অধিদপ্তর সম্মতিও দিয়েছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, স্থানীয় জাতের গাছগুলো যেন নির্দারণ করা হয় রোপণের জন্য। শুধু স্থানীয় জাত হলেই হবে না, উদ্দেশ্যটাও লক্ষণীয়। কিছু জায়গায় নান্দনিক প্রয়োজনে গাছ লাগাতে হবে। সেই জায়গায় এক ধরনের গাছ আবার কিছু জায়গায় অর্থনৈতিক প্রয়োজনে গাছ লাগানো যেতে পারে, সেই জায়গায় স্থানীয় যেসব জাতের গাছ থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়, সেই সব গাছ লাগাতে হবে। এ জন্য অবশ্যই একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি রাখা যেতে পারে, যারা স্থানীয় কোনো জাতের গাছ কোথায় লাগাতে হবে, তা নির্ধারণ করে দেবে। তবে এ কথা অকপটে বলে দেওয়া যায়, এই নগর বনায়নের প্রচেষ্টা সফল হলে ঢাকার বায়ুদূষণ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হবে।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক


https://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2024/07/05/1403352?fbclid=IwZXh0bgNhZW0CMTEAAR1Z5KdzZZ_GawKrb2x4DpMzyENaoL_7Z7PszmOS9voT_8Pg0_m4WBhn8wM_aem_20Yw19ijLfwUUXnuUllUZQ


 

No comments:

Post a Comment