9/28/2024

বন্যা বন্য প্রাণীর অস্তিত্ব সংকট ড. বিভূতিভূষণ মিত্র

 বন্যা

বন্য প্রাণীর অস্তিত্ব সংকট

ড. বিভূতিভূষণ মিত্র

প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৪৫ এএম

ড. বিভূতিভূষণ মিত্র

বন্যা হলোÑযেখানে পানির প্রবাহ স্বাভাবিকের চাইতে বেশি থাকে। কোনো নদী থেকে সৃষ্টি হয়ে সমতলভূমিকে প্লাবিত করে। কিন্তু বাংলাদেশের বন্যা ভিন্ন। এখানে বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় প্রভৃতি পানিতে ভেসে যায়। এতে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ডুবে যায়। বাংলাদেশে মূলত তিন ধরনের বন্যা দেখা যায়। এগুলো হলো মৌসুমি বন্যা, আকস্মিক বন্যা ও জোয়ারে সৃষ্ট বন্যা। মৌসুমি বন্যা হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ে। এতে নির্দিষ্ট এলাকা প্লাবিত হয়। ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করে। আকস্মিক বন্যা হয় পাহাড়ি ঢল বা হঠাৎ অনবরত বৃষ্টি থেকে। আর জোয়ারের সময় যে বন্যা হয় তাকে জোয়ারের ফলে সৃষ্ট বন্যা বলে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়। অর্থাৎ ১৮ শতাংশ এলাকা বন্যার কবলে পড়ে। বন্যা ব্যাপকভাবে হলে ৫৫ শতাংশ ডুবে যায়। বাংলা অঞ্চলে প্রতি শতাব্দীতেই অর্ধডজন বন্যা দেখা গেছে। এসব বন্যা ভয়াবহ বন্যা হিসেবেই স্বীকৃত।

বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেকবারই বন্যার দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম বন্যা দেখা যায় ময়মনসিংহে ১৯৭৪ সালে। সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা দেখা যায় ১৯৮৮ সালে। এর আগে ১৯৮৭ সালের বন্যায়ও কম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। স্বাধীনতার আগে এ অঞ্চলে ১৭৮১, ১৭৮৬, ১৭৯৪, ১৮২২, ১৮২৫, ১৮৩৮, ১৮৫৩, ১৮৬৪, ১৮৬৫, ১৮৬৭, ১৮৭১, ১৮৭৬, ১৮৭৯, ১৮৮৫, ১৮৯০, ১৯০০, ১৯০২, ১৯০৪, ১৯১৫, ১৯৫৫, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৬৯ সালে স্মরণ করার মতো বন্যা হয়েছে। সম্প্রতি গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দি এনভায়রনমেন্ট এবং সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিকসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যায় ৫৫-৬০ শতাংশ জলমগ্ন হয়। এতে ১ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের ক্ষতি হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে এও বলা হয়, দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ বন্যার উচ্চঝুঁকিতে আছে। এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে বলে বলা হয়েছে এবং এ থেকে ভয়াবহ বিপর্যয়ও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।

বন্যার কারণে বন্য প্রাণী মূলত স্থানান্তরিত হয়। এরা উঁচু জায়গায় অবস্থান করে। কখনও কখনও বন্যার সময় বন্য প্রাণীরা গাছে আশ্রয় নেয়। এ ছাড়া অস্থায়ীভাবে কোনো দ্বীপে অবস্থান করে। এরা বন্যার পানি চলে না যাওয়া পর্যন্ত বেশ কিছুদিন এভাবে থাকতে পারে। তারপর পানি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানান্তরিত হয়। এ সময় বন্য প্রাণীরা খাবারের জন্য মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কেননা বন্যাদুর্গত এলাকায় তারা সহসাই যেতে পারে না। এ সময় তাদের মধ্যে পুষ্টির অভাব ঘটে। অনেক সময় বিষাক্ত খাবারও তারা খেয়ে ফেলে। বন্য প্রাণীর মধ্যে রোগবালাই ছড়াতে থাকে। অনিরাপদ খাদ্য খাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। আগ্রাসি বন্য প্রাণী দুর্বল প্রাণীদের ওপর চড়াও হয়। বিপদাপন্ন প্রজাতি বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়ে যায়। অনেক দেশে বন্যার সময় ক্যাঙ্গারুরা রাস্তায় উঠে পড়ে। এ সময় তারা সড়ক দুর্ঘটনায পড়ে। অতিরিক্ত বৃষ্টি ও পানিপ্রবাহের কারণে যেসব বন্য প্রাণী গাছের খোঁড়লে, মাটির গর্তে বাসা বানিয়ে থাকত, সেসব বাসা নষ্ট হয়ে যায়। বন্যার কারণে অনেক নিশাচর প্রাণীকে দিনের বেলায়ও দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে বন্য প্রাণী উদ্ধারকর্মীদের জানা থাকতে হবে কীভাবে বন্যার সময় বন্য প্রাণী উদ্ধার করতে হয়। সাময়িক সময়ের জন্য উঁচু জায়গা তৈরি করা দরকার। এ সময় অনেক বন্য প্রাণী আহত হয়ে পড়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের বন্য প্রাণীর প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বন্যার সময় অনেক সাপ মারা পড়ে। দেখা যায় অধিকাংশ সাপই বিষাক্ত নয়।

 গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ”র খবর পড়তে ফলো করুন

মানুষ আতঙ্কে এসব সাপ মেরে ফেলে। কোন ধরনের সাপ বিষাক্ত এবং কোনটি নয় তা জানা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে বন্য প্রাণী উদ্ধারকর্মীদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। বিড়াল ও শিয়াল বন্যার সময় লোকালয়ে আশ্রয় নেয়। অধিকাংশ গ্রামবাসীর মধ্যে এসব মেরে ফেলার আশঙ্কা থাকে। লোকালয়ে আশ্রয় নেওয়া বন্য প্রাণী হত্যা না করে বন বিভাগকে জানাতে হবে। বন্যার সময় জলজ প্রাণী বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোয় কুমিরকে বন্যার সময় লোকালয়ে এসে পড়তে দেখা যায়। পোকামাকড়, বাদুড়, পাখি উড়তে জানে বিধায় এরা অন্য জায়গায় সহজেই স্থানান্তরিত হতে পারে। তবে বেশি বৃষ্টিপাত হলে অনেক পাখিই উড়ে যেতে পারে না। তারা আশ্রয় খোঁজে। এ সময় পাখি বিপদসংকুল অবস্থায় থাকে। বিড়াল, শিয়াল প্রভৃতি এ পাখিকে খেয়ে ফেলে। কিছু গিরগিটি ও ব্যাঙ গাছে উঠতে পারে। এরা নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারে অন্য কারও সহায়তা ছাড়াই।

বন্যার সময় বড় যে অসুবিধাটা হয় তা হলো, সুপেয় পানির অভাব। বন্যার পানি অনেক বিষাক্ত হয়। এ পানি পান করে অনেক বন্য প্রাণী অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মাছ মরে যায়। এ কারণে খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ে। খাদ্যশৃঙ্খল কিছুটা ভেঙে পড়লেও অধিকাংশ বন্য প্রাণী এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে অভিযোজিত। যে বন্য প্রাণীগুলো কোনো কারণে বিপদগ্রস্ত হয়, সেই বন্য প্রাণীগুলো নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে। যতটুকু সম্ভব তাদের ধরে নিরাপদ জায়গায় রেখে আসতে হবে। অল্প কিছু এলাকায় হালকা বন্যা হলে বন্য প্রাণীরা অভিযোজিত হতে পারে। কিন্তু মারাত্মক বন্যা বন্য প্রাণীর ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে। বন্যার পানি পাখির বাসা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ছোট ছোট প্রাণী যারা নিচু এলাকায় থাকে তারা ডুবে যায়। বন্যায় বন্য প্রাণীরা সাধারণত উঁচু এলাকায় চলে যায়। সাপ আশপাশের কোনো জায়গায় আশ্রয় নেয়। এমন জায়গায়ও আশ্রয় নিতে দেখা যায় যেখানে সাপ গত কয়েক বছরে যায়নি। আবহাওয়ার হঠাৎ কোনো পরিবর্তন হলে সাপ শুষ্ক এলাকায় চলে যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বন্য প্রাণীদের এমন আচরণ সাময়িক সময়ের জন্য দেখা যায়। মাছরাঙা সাধারণত বালুতীরে বাসা বাঁধে। কারণ বালুমাটি নরম হওয়ায় সহজেই গর্ত খুঁড়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। এটা করে যেন কোনো শিকারি তাদের খুঁজে না পায়। বন্যার ফলে এ ধরনের পাখির বাসা সহজইে ধ্বংস হয়ে যায়। ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী যখন স্থান পরিবর্তন করে বন্যার সময়, তখন তারা শিকারের কবলে পড়ে।

শিক্ষক ও গবেষক


No comments:

Post a Comment