9/28/2024

আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড বন্ধ হোক ড. বিভূতিভূষণ মিত্র

 

×
উপকূলীয় বন ধ্বংস

আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড বন্ধ হোক

ড. বিভূতিভূষণ মিত্র

প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৪৯ এএম

ড. বিভূতিভূষণ মিত্র

ড. বিভূতিভূষণ মিত্র

রাস্তার ধার ও বেড়িবাঁধ বরাবর গাছপালা লাগিয়ে যে বেষ্টনী করা হয় তা-ই সবুজ বেষ্টনী। উপকূলবরাবর বৃক্ষ রোপণ করে যে বনায়ন করা হয় তা-ই উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী। জলোচ্ছ্বাস ও ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর আগে ১৯৬৬ সালে ম্যানগ্রোভ বনায়ন শুরু হয়। মূলত জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা এবং কৃষিজমি, জানমাল রক্ষায় উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী উপকূলীয় এলাকায় জেগে ওঠা চরে ১৯৬৫ সাল থেকে বন সৃষ্টি করা হচ্ছে, যাকে প্যারাবনও বলা হয়। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও কক্সবাজার জেলায় এ প্যারাবন গড়ে উঠেছে, যা নানাভাবে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে জানমাল ও দেশ রক্ষা করে যাচ্ছে। প্রায় ১ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর ভূমিতে এ বন তৈরি করা হয়েছে। এটি দেশের আয়তনের ১.৩৬%। বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনের পরিমাণ ১২.৫০%। এ প্যারাবনের কেওড়া, ছইলা, বাইন, গোলপাতা প্রভৃতি উদ্ভিদ প্রজাতি দেখা যায়। বন্য প্রাণীর মধ্যে হরিণ, মেছোবাঘ, শিয়াল ইত্যাদি রয়েছে। পাখিদের মধ্যে কালালেজ জৌরালি, দেশি গাঙচষা, কালামাথা কাস্তেচরা, খয়রাপাখ মাছরাঙার দেখা মেলে।

২০০৯-২০১০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১ লাখ ১ হাজার ৫৯৮ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উপকূলীয় এলাকায় ১১ হাজার ৭৪৫ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বনায়ন করা হয়েছে। ১৯৭৭ সালে উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৮ হাজার একর জমিতে বনায়ন করা হয়। আশির দশকে বনভূমির পরিমাণ দাঁড়ায় লক্ষাধিক একরে। বন বিভাগ ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ একর উপকূলীয় বনায়ন করে। বলা হয়, এটিই প্রথম বিশ্বের সর্ববৃহৎ উপকূলীয় বনায়ন প্রকল্প। একটি তথ্যমতে, ষাটের দশকে ১ হাজার ১০০ একর জমিতে ম্যানগ্রোভ জাতের গাছ লাগানো হয়। গেওয়া, কেওড়া, ছইলা এখানে উল্লেখযোগ্য। মূলত ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পরই উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কেননা এ ঘূর্ণিঝড়ে আমরা ব্যাপক মাত্রার ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হই। এ ঝড়ে বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিমি। তখন সমুদ্র থেকে ২০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ঢেউ হয়েছিল। মানুষ মারা গিয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজারের মতো। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ২৪০ মিলিয়র মার্কিন ডলারের। এরপর ২০০৭ সালেও ঘূর্ণিঝড় সিডর হয়। এ সময় বরগুনা, পটুয়াখালী ও ঝালকাঠিতে মারাত্মক জলোচ্ছ্বাস দেখা যায়। এতে সুন্দরবনের এক চতুর্থাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর আইলা, নার্গিস নামে ঘূর্ণিঝড় হলেও উপকূলীয় বেষ্টনী থাকায় ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কম হয়েছিল।

Rupali Bank

উপকূলবর্তী হওয়ায় এসব বন সমুদ্র দ্বারা প্রভাবিত। সৈকত, মোহনা, জলাভূমি, মাটির প্রকৃতির কারণে এটি একটি স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র গঠন করেছে। এর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন সময় আইলা, আম্ফান ও ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বনে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে। মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যায়। এতে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সুন্দরী, কেওড়া, গোলপাতাসহ বিভিন্ন গাছ মারা যায়। প্যারাবনগুলোর অবস্থাও তাই। বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বনায়নের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর থেকে ১ হাজার ৬৮০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ভূমি মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। উপকূলীয় চরাঞ্চলে ২ হাজার ৫২১ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বনায়ন করা হয়েছে। এর ফলে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদী ভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছে দেশ। উপকূলের ১ লাখ ১২ হাজার ৬৩ একর জমি শস্য উৎপাদনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে ফেরত দেওয়া হয়েছে। সবুজ বেষ্টনীর কারণে বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম ও মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বনজ সম্পদ সৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা, জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে কাজ চলছে। এর ফলে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার মানুষ নতুন উদ্যমে কাজ করার স্পৃহা পাচ্ছে।

Google News গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ”র খবর পড়তে ফলো করুন

বাংলাদেশে অধিকাংশ বন ধ্বংস হচ্ছে দখলের মাধ্যমে। বন বিভাগের তথ্যমতে, সারা দেশে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বন দখলে চলে গেছে। ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গড়ে ২৫ হাজার একর বনভূমি দখল হয়েছে। এসব বন ধ্বংসের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বন্য প্রাণী। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর নেচার কনজারভেশনের ২০১৫ সালের প্রতিবেদনমতে, বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রাণিপ্রজাতির সংখ্যা ৩১। ১৬০০ প্রাণিপ্রজাতির মধ্যে ৩৯০টি হুমকির মধ্যে রয়েছে। আর ৫০টির বেশি প্রজাতি ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী উপকূলীয় অঞ্চলের এসব বন প্রতিনিয়ত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একদিকে যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বনাঞ্চল বিলীন হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় প্রভাবশালীরা নির্বিচারে ধ্বংস করে যাচ্ছে বন। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে, মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের ৩ সহস্রাধিক একর প্যারাবন কেটে ছোটবড় অর্ধশত চিংড়ি ঘের নির্মাণ করেছে প্রভাবশালীরা। পত্রিকায় জানানো হয়েছে, এ রকম কয়েক হাজার একর প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়ি ঘের বানানো হয়েছে। পরিবেশবিদরা শঙ্কা প্রকাশ করলেও এসবের সুরাহা হচ্ছে না। এ ছাড়া বন কেটে কারখানা তৈরি, বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণ, পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন করায় এসব বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

ভূমিদস্যু ও অতিরিক্ত লোভী মানুষের জন্য বনাঞ্চলগুলো বিলীন হওয়ার পথে। ‘মহেশখালীতে প্যারাবন ধ্বংস করে তৈরি হচ্ছে চিংড়ি ঘের, লবণ মাঠ’, ‘মহেশখালীর সোনাদিয়ায় প্যারাবন কেটে আরও চিংড়ি ঘের তৈরি’, ‘মহেশখালীতে প্যারাবন ধ্বংস করে ২৫০ একর ভূমি দখলের অভিযোগ’ এ রকম অসংখ্য প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর পরও এর বিরুদ্ধে আশানুরূপ কোনো উদ্যোগ কর্তৃপক্ষ নেয়নি। প্রকৃত আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। এভাবে প্যারাবন ধ্বংস হতে থাকলে মারাত্মক বিপর্যয়ের সামনে পড়বে মানুষ। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাবে। জানমাল রক্ষায় তাই প্যারাবন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। বন ধ্বংসে যে আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড চলছে এর অবসান ঘটাতে হবে সময়ক্ষেপন না করে। এ ব্যাপারে চাই কঠোর অবস্থান।

  • শিক্ষক, পরিবেশ ও জলবায়ু গবেষক

No comments:

Post a Comment