9/28/2024

সুন্দরবন অরক্ষিত বন্য প্রাণী


সুন্দরবন


অরক্ষিত বন্য প্রাণী


ড. বিভূতিভূষণ মিত্র


প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৪ ১০:১৪ এএম




ড. বিভূতিভূষণ মিত্র


সুন্দরবনের পরিবেশ আগের মতোই থাকবে তো? বেঁচে থাকবে তো বাংলাদেশের গৌরবদীপ্ত-উজ্জ্বল-ক্ষিপ্র-তেজি-রাজসিক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার? অনেক বিজ্ঞানী অবশ্য বলছেন, আগামী ৫০ বছরে হয়তো বা এ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। কেননা সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার ওপর নির্ভর করে বাঘের প্রজনন। সে প্রজননের পরিবেশ টিকিয়ে রাখাই এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা একদিকে সুন্দরবনের নিকটবর্তী শিল্পকারখানা গঠন করা হচ্ছে, অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে; অন্যদিকে খালে বিষ প্রয়োগ করে ধরা হচ্ছে মাছ। এতে বাস্তুতন্ত্রের ওপর আঘাত হানছে। সুন্দরবেনর আয়তন মোট ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন। এর ৬২ শতাংশ বাংলাদেশে আর ৩৮ শতাংশ ভারতে পড়েছে। এটি পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় অবস্থিত। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার কিছু এলাকা এ বনের বাংলাদেশ অংশ। সুন্দরবন ১৯৯২ সালে রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষিত হয়। পরে ১৯৯৭ সালে একে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো।


সুন্দরবন বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঢাল হিসেবেই শুধু কাজ করে না, এর ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভর করে বেঁচে থাকে লাখ লাখ মানুষ। সুন্দরবন থেকে আহরিত কাঠ-গাছপালা থেকে বিভিন্ন আসবাবপত্র যেমন তৈরি হয়, তেমন নিউজপ্রিন্ট, দিয়াশলাই, হার্ডবোর্ড, নৌকা প্রভৃতিও তৈরি করার উপাদান সংগ্রহ করা হয় এখান থেকে। এখান থেকে আহরিত মধু এখন বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। সুন্দরবন সব সময় তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারে না। ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে। যেমন সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ১৩৪টি হরিণ, ৪টি বন্যশূকর মারা গেছে। পুরো সুন্দরবন টানা ৩৬-৩৭ ঘণ্টা লবণাক্ত পানির নিচে থাকায় অনেক গাছপালা মারা গেছে।




এ ছাড়া নদী ভাঙন, অবৈধ বসতি, গাছ কাটার ফলে সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে ১৪৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা। ২০২০ সালে বিশ্ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমে হয়েছে ১১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯০৪ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে হয় ১১ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার। ২০২৪ সালে বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী সুন্দরবনের আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এলাকা মিলিয়ে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় নদী ভাঙনের শিকার হচ্ছে। এতে কমে যাচ্ছে সুন্দরবনের নিজস্ব এলাকা। অন্যদিকে বনের ভেতর দিয়েই মানুষ চলাচলের রাস্তা-ঘরবাড়ি নির্মাণ করছে। যে বৃক্ষের নামে সুন্দরবন সেই সুন্দরী বৃক্ষই কমে গেছে ২৮.৭৫ ভাগ। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনমতে, সুন্দরবনের চারদিকে ১০ কিলোমিটার এলাকা সংকটাপন্ন অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করলেও মানা হচ্ছে না কিছুই। বিভিন্ন স্থাপনা যেমন রিসোর্ট, কটেজ নির্মাণ করা হচ্ছে। সুন্দরবন দূষণের আরেকটি বড় কারণ নদী ও খালে জাহাজের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল। কারণ এসব জাহাজ চলাচলে তেল নিঃসরণ হচ্ছে। সুন্দরবনে প্রায়ই আগুন লাগে। পানিপ্রবাহও আগের মতো নেই। শুষ্ক অঞ্চলে পানিপ্রবাহ কমে যায় প্রায় ৪০ শতাংশ। এতে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। গত ২৫ বছরে ঘন বনের পরিমাণ কমেছে ২৫ শতাংশ।


 গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ”র খবর পড়তে ফলো করুন


কিন্তু সুন্দরবনের নানা বন্য প্রাণী তথা বাঘ কতটা সংরক্ষিত? কিছুদিন আগেও শরণখোলায় একটি বাঘের মৃতদেহ উদ্ধার করেন খোদ বনরক্ষীরা। একটি তথ্যমতে সুন্দরবনে প্রথম বাঘজরিপ হয় ২০১৩-১৪ সালে। সে সময় বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬। এক দশকে বাঘ কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ। ২০০৪ সালে ছিল ৪৪০টি। তবে এ সংখ্যাটি বাংলাদেশ ও ভারত দুই অংশের সুন্দরবন মিলিয়ে। ২০১৮ সালে বাঘশুমারিতে পাওয়া গিয়েছিল ১১৪টি। ২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে কমপক্ষে ৪৬টি বাঘ মারা হয়েছে। সুন্দরবনে একসময় ৪০০ প্রজাতির পাখি বাস করলেও এখন মাত্র ২৭০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে।


সুন্দরবনে ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণী বসবাস করে। এর মধ্যে হরিণ, বানর, শূকর, শজারু, গুঁইসাপ বাঘের খাদ্য। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচার সংক্ষেপে আইইউসিএনের জরিপ অনুযায়ী হরিণসহ এ পাঁচ প্রজাতির সংখ্যা বেড়েছে। ২০০৪ সালে চিত্রল ও মায়া হরিণের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪-এ। বানর ৫১ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৪। বন্যশূকর ২৮ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৭ হাজার ৫১৫। সুন্দরবনে এবারই প্রথম জরিপ করা হয় গুঁইসাপ ও শজারু। গুঁইসাপ দেখা গেছে ২৫ হাজার ১২৪টি আর শজারু পাওয়া গেছে ১২ হাজার। সুন্দরবনের এখন সব বন্য প্রাণীর সংখ্যা ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৯২৮। খুশির খবর হলো, বাঘের সংখ্যাও বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতি বছর ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবসে এ সংখ্যাটি জানানো হয়। ২০২৪ সালে অনিবার্য কারণে জুলাইয়ের সংখ্যা জানা না গেলেও আগস্টে জানা যাবে বলা হয়েছে। তখন হয়তো সংখ্যার বিষয়টি আরও স্পষ্ট করা যাবে।


বন বিভাগ সুন্দরবন রক্ষায় কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। যেমন সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প, সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প। এসবের মাধ্যমে অভয়ারণ্য এলাকা বাড়ানো হয়েছে। ২০২১ সাল থেকে রাসমেলা বন্ধ করে শুধু পুণ্যস্নান ও রাসপূজার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত বন্য প্রাণীর প্রজননকালে বনজদ্রব্য সংগ্রহ ও পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে; যাতে বন্যপ্রাণীর প্রজনন বাধাগ্রস্ত না হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র ও বাংলাদেশে সুন্দরবনের মোট এলাকার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০ থেকে ২৫০টি বাঘ থাকা দরকার। একসময় অধিকাংশ দেশে বাঘ পাওয়া গেলেও এখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের মোট ১৩ দেশে একে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গত ১০০ বছরে বাঘের সংখ্যা ৯৫ শতাংশ কমলেও এর সংখ্যা এখন বাড়ছে। সুন্দরবনের আবাসস্থলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও শিকারিদের দৌরাত্ম্য কমাতে পারলে অচিরেই এর সংখ্যা স্বাভাবিক পর্যায়ে আসবে বলে আশা করা যায়।


শিক্ষক ও গবেষক


No comments:

Post a Comment