9/28/2024

শুশুকের অসুখ ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 




প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৪, ০৮:৪৪

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্রবেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের দৈনিকগুলোয় হালদা নদীতে ডলফিন মারা যাওয়ার খবর প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে দুই প্রজাতির ডলফিন রয়েছে। একটিকে গাঙ্গেজ ডলফিন বলা হয়, আরেকটি ইরাবতী ডলফিন। গাঙ্গেজ ডলফিনকেই শিশু বা শিশুক বা শুশুক বলা হয়। এটি মূলত মিঠাপানির ডলফিন। আর ইরাবতী ডলফিন সাগর বা সাগর নিকটবর্তী নদীতে পাওয়া যায়। হালদা নদীর ডলফিনকে শুশুক বলা হয়। এটি গাঙ্গেজ ডলফিন।

হালদা নদী বাংলাদেশের পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। এটি খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলায় পড়েছে। এর দৈর্ঘ্য ১০৬ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৩৪ মিটার। নদীটি দেখতে সর্পিলাকার। হালদা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র। এই নদীতে জোয়ার-ভাটা ঘটে। মিঠাপানির মাছ এই নদীতে ডিম ছাড়ে। হালদা পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখানে কার্পজাতীয় মাছ যেমন রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ ডিম পাড়ে। সেই ডিম সংগ্রহ করা হয়। পৃথিবীর আর কোথাও এমন নদী নেই, যেখান থেকে মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়।

হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ডলফিন পাওয়া গেছে ১৬৭টি, ২০২০ সালে ১২৭টি। গাঙ্গেয় ডলফিন পৃথিবীর বিপন্ন প্রজাতির একটি। এর মধ্যে হালদায় রয়েছে ১৭০টি। এই ডলফিন গঙ্গা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও কর্ণফুলীতে পাওয়া যায়। ভারত ও নেপালেও এটি দেখা যায়। শুশুকের মুখের চোয়াল সামনের দিকে বাড়ানো, প্রতি চোয়ালে ২৮ থেকে ২৯টি দাঁত থাকে। পুরুষ শুশুক থেকে বড় স্ত্রী শুশুক। স্ত্রী শুশুক গড়ে ২.৪ থেকে ২.৬ মিটার লম্বা। আর পুরুষ শুশুক গড়ে ২ থেকে ২.২ মিটার লম্বা। এরা কিন্তু ডিম পাড়ে না। সন্তান প্রসব করে এবং স্তন্যদান করে।

বাংলাদেশে শুশুককে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রাখা হয়েছে। একটি তথ্যমতে, এই প্রজাতির সংখ্যা সারা বিশ্বে প্রায় ৩ হাজার। বাংলাদেশে বাস করে পৃথিবীতে বাস করা মোট প্রজাতির এক-তৃতীয়াংশ; অর্থাৎ সুন্দরবনে ২২৫, পদ্মা-যমুনায় ২০০, কর্ণফুলী, সাঙ্গু, সুরমা, হালদায় প্রায় ৫০০টি। ডলফিনকে পানির ওপরে সাঁতরাতে ও লাফাতে বেশি দেখা যায়। এরা ৩-৪ মিনিট পরপর পানির ওপরে উঠে শ্বাস নেয় আর ছাড়ে। এই ডলফিনের কিছু মজার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এরা চোখে দেখতে পায় না। তীক্ষ্ণ শব্দ ছোড়ার মাধ্যমে শিকার খোঁজে। এদের ওজন ১৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। দুই-তিন বছরে একবার বাচ্চা দেয়। এর গড় আয়ু ২০ থেকে ২২ বছর।

এই শুশুক কিন্তু মানুষের বন্ধুও বটে। অনেক জেলে শুশুক দিয়ে মাছ শিকার করে। এমন বন্ধু শুশুককেও মানুষ নির্বিচারে হত্যা করে। অথচ শুশুক মানুষের কোনো ক্ষতিই করে না। এ ছাড়া শীতলক্ষ্যা নদীতে প্রায়ই মা ও বাচ্চা শুশুক মরে ভেসে উঠতে দেখা যায়। এর কারণ, শীতলক্ষ্যা নদীর পানিতে সার কারখানার অ্যামোনিয়া বর্জ্যের আধিক্য। একটি তথ্যমতে, ২০২২ সালে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতেই মৃত ডলফিন পাওয়া যায় ১৮টি। ২০২১ সালে পাওয়া যায় ২৪টি।

সুন্দরবনে ডলফিন রক্ষায় ৬টি অভয়ারণ্য রয়েছে। ডলফিন রক্ষায় সরকারেরও অ্যাকশন প্ল্যান রয়েছে। তা সত্ত্বেও এর মৃত্যু কিন্তু থেমে নেই। আইইউসিএনের বিপন্ন তালিকায় থাকা এই শুশুক রক্ষা করতে না পারলে একদিন এটি হয়তো হারিয়েই যাবে। তাই শুশুকের এই অসুখ আমাদের সারাতেই হবে। এ জন্য ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র—সব জায়গা থেকেই শুশুক রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ জরুরি। 

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র, শিক্ষক ও গবেষক

No comments:

Post a Comment