ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জরুরি
অন্যদৃষ্টি
ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জরুরি
বিভূতি ভূষণ মিত্র
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:০৬
ই-বর্জ্য বলতে ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক সামগ্রীকে বোঝায়, যার অর্থনৈতিক উপযোগিতা নেই। ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য বা যন্ত্রপাতিগুলোকে পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। যেমন– ঘরোয়া যন্ত্রপাতি; বিভিন্ন ধরনের ল্যাম্প, কাপড় ধোয়ার যন্ত্র, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, হিটার, ক্লিনার, টোস্টার, ব্যাটারি, টেলিভিশন, রেডিও, ডিভিডি প্লেয়ার, ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা ইত্যাদি। ধোঁয়া নির্ণয়কারী যন্ত্র, তাপ নিয়ন্ত্রক, থার্মোস্ট্যাট, ধোঁয়া নির্বাপক ইত্যাদি নিয়ন্ত্রক যন্ত্রপাতি। মাইক্রোস্কোপ, এমআরআই যন্ত্র, এন্ডোস্কোপি যন্ত্র, এক্স-রে মেশিন, আলট্রাসাউন্ড প্রভৃতি চিকিৎসা যন্ত্রপাতি এবং ল্যাপটপ, স্ক্যানার, ক্যালকুলেটর, নোটবুক, প্রিন্টার, মনিটর, ফ্যাক্স প্রভৃতিকে তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ধরা হয়।
ই-বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে। এক পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে বছরে ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১৮ সালে ই-বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে ১০ লাখ টন বর্জ্য তৈরি হয়। প্রতিবছর ই-বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে ৩০ শতাংশ করে। এই চিত্র শুধু বাংলাদেশ নয়; সারা বিশ্বেই ই-বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ইওয়েস্ট মনিটরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বে ই-বর্জ্যের পরিমাণ ৬২ মিলিয়ন টন। এসব বর্জ্যের রিসাইক্লিং তেমন একটা হয় না বাংলাদেশে। প্রতিবছর দেশে মাত্র ১৩ হাজার ৩০০ টন ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং হয়।
ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর ঝুঁকিও অনেক। ২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৫ শতাংশের বেশি শিশু মারা যায় ই-বর্জ্যের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ই-বর্জ্যের কারণে ফুসফুস ও স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এখন সিআরটি মনিটরের পরিবর্তে এলইডি মনিটর প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এসবে সিসা, ক্যাডমিয়াম, বেরিয়াম, ফ্লুরোসেন্ট পাউডার থাকে; যা মাটি-জল-বাতাসকে দূষিত করে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। চীনের গুইউকে বলা হয় ই-বর্জ্যের রাজধানী। কেননা, এখানে বিশ্বের ৭০ শতাংশ ই-বর্জ্য এই শহরের ওপর দিয়ে যেত। এ শহরে দুটি ভয়াবহ ঘটনা দেখা গেছে। এক. এখানকার মহিলাদের ৬ গুণ বেশি গর্ভপাত হয়েছে। দুই. এখানকার ৭০ ভাগ শিশুর দেহে অস্বাভাবিক মাত্রার সিসা পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১ নামে একটি বিধিমালা রয়েছে। এই বিধিমালায় প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারীর দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে। ই-বর্জ্য মজুতকরণ পদ্ধতি সম্পর্কেও বিধিমালায় বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, সংগ্রহ কেন্দ্র, চূর্ণকারী, মেরামতকারী এবং পুনর্ব্যবহার উপযোগীকরণকারী ই-বর্জ্য ১৮০ দিনের বেশি সময় মজুত করতে পারবে না। আবেদনকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তবে তা ৯০ দিন পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে কিনা, ই-বর্জ্য মাটি-পানি-বাতাসের সঙ্গে সহজেই মিশে যায় কিনা, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
বেশ কিছু দিন আগে বাংলাদেশে পালিত হলো ই-বর্জ্য দিবস। দিবসটি উপলক্ষে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় রিসাইক্লিং শিল্পই হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান। এছাড়া তিনি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা কার্যকর করার কথা যেমন বলেন, তেমনি ইলেকট্রনিক পণ্য অল্প সময় ব্যবহার করেই বাতিল না করার পরামর্শ দেন। সত্যিকার অর্থে তাই যে রিসাইক্লিংই অর্থাৎ ই বর্জ্য পুনর্ব্যবহারই এর উৎকৃষ্ট সমাধান। এই ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে পারেন। ই-বর্জ্য থেকেও মূল্যবান সামগ্রী পুনরুদ্ধার করা যায়। এসব বিদেশে রপ্তানি করা যায়। এছাড়া মেমোরি কার্ড ও মাদারবোর্ডের মতো ই-বর্জ্য থেকে সোনা, রুপা, তামা, টিন পুনরুদ্ধার করা যায়। এসব এখন গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। এ ব্যাপারেও মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে। যারা রিসাইক্লিংয়ের পাশাপাশি হয়ে উঠতে পারে সফল উদ্যোক্তা। সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধিত করার পাশাপাশি প্রণোদনাও দিতে পারে।
ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র: শিক্ষক ও গবেষক
No comments:
Post a Comment