কপ-২৯
জলবায়ু অর্থায়নে ন্যায়বিচার ও সমতার দাবি
ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫১ এএম

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সম্মেলন অর্থাৎ কনফারেন্স অব পার্টিজের ২৯তম আসর বসেছে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। এই সম্মেলন ১১ নভেম্বর শুরু হয়েছে। শেষ হবে ২২ নভেম্বর। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এ সম্মেলনে অংশ নেয়। সদস্য সংখ্যা ১৯৮। ১৯৭ দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলে মোট ১৯৮। এ সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, সরকারি কর্মকর্তারা ছাড়াও পরিবেশবিষয়ক বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, আদিবাসী প্রতিনিধি, গবেষণা প্রতিষ্ঠানও অংশ নিতে পারে। সারা বিশ্বের জলবায়ু, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে নীতিনির্ধারণী আলোচনা করা হয়। পরিবেশ ও জলবায়ুসংক্রান্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রতি বছর এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান এলাকাগুলো থেকে কপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। পর্যায়ক্রমে সেসব দেশেই কপ হয়ে থাকে। কোনো কারণে কোনো দেশ অপারগ হলে তা জার্মানির বনে অনুষ্ঠিত হবে। কপের শুরু ১৯৯২ সালে রিওডি জেনেরিওতে। তবে তা ছিল মূলত আর্থ সামিট। এরপর ১৯৯৫ সালে বার্লিনে কপ হয়। এটিই আসলে কপের প্রথম সভা। এ সম্মেলনের মাধ্যমে কিয়োটো প্রটোকল, প্যারিস চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।


প্যারিস চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ এ চুক্তিতে বলা হয়Ñ উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা করবে। এ সহায়তা ২০২০ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। কিন্তু এটা শুধু চুক্তিই ছিল। সাহায্য যা এসেছে তা একেবারেই অপ্রতুল। সাহায্য না এলেও তৃতীয় বিশ্ব উন্নত দেশ দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি লেগেই আছে। প্যারিস চুক্তিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো, এ বিশ্বের তাপমাত্রা এ শতাব্দীর মধ্যে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখা। এ ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন নিঃসরণ ৫০ ভাগে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে তাপমাত্রা কিন্তু বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই। উন্নত দেশগুলোয় যে হারে শিল্পবিপ্লব হয়েছে, একই হারে তারা পরিবেশদূষণ ঘটিয়েছে। এর কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ২১০০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১.৬২ সেন্টিমিটার বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া কার্বন নিঃসরণের কারণে বন্যা-খরা-প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। গত এক শতকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিজ্ঞানীদের মতে, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে ১ মিটার। এতে ৪৩টি দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে হারিয়ে যেতে পারে।
 গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ”র খবর পড়তে ফলো করুন
বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমাদের অধিকাংশ অঞ্চল বন্যাপ্রবণ। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকা প্রতি বছর বন্যার কবলে পড়ে। এ ছাড়া নদীভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল। বাংলাদেশের মোট ১৮ ভাগ জমি বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ফলে নিম্নভূমি প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এতে কৃষি, নানান অবকাঠামো ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। অন্যদিকে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল খরাপ্রবণ হওয়ায় পানিসংকটের সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশে মূলত তিন ধরনের বন্যা দেখা যায়। এগুলো হলো মৌসুমি বন্যা, আকস্মিক বন্যা ও জোয়ারে সৃষ্ট বন্যা। মৌসুমি বন্যা হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ে। এতে একটি এলাকা প্লাবিত হয়। ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করে। আকস্মিক বন্যা হয় পাহাড়ি ঢল বা হঠাৎ অনবরত বৃষ্টি থেকে। আর জোয়ারের সময়ে যে বন্যা হয় তাকে জোয়ারের ফলে সৃষ্ট বন্যা বলে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়। অর্থাৎ ১৮ শতাংশ এলাকা বন্যার কবলে পড়ে। বন্যা ব্যাপকভাবে হলে ৫৫ শতাংশ ডুবে যায়। বাংলা অঞ্চলে প্রতি শতাব্দীতেই অর্ধডজন বন্যা দেখা গেছে। এগুলো ভয়াবহ বন্যা হিসেবেই স্বীকৃত।
বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেকবারই বন্যার দেখা মিলেছে। এমনকি রামায়ণ-মহাভারতেও এ অঞ্চলের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম বন্যা দেখা যায় ময়মনসিংহে ১৯৭৪ সালে। সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা দেখা যায় ১৯৮৮ সালে। এর আগে ১৯৮৭ সালের বন্যায়ও কম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। স্বাধীনতার আগে এ অঞ্চলে ১৭৮১, ১৭৮৬, ১৭৯৪, ১৮২২, ১৮২৫, ১৮৩৮, ১৮৫৩, ১৮৬৪, ১৮৬৫, ১৮৬৭, ১৮৭১, ১৮৭৬, ১৮৭৯, ১৮৮৫, ১৮৯০, ১৯০০, ১৯০২, ১৯০৪, ১৯১৫, ১৯৫৫, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৬৯ সালে স্মরণ করার মতো বন্যা হয়েছে। সম্প্রতি গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দি এনভায়রনমেন্ট এবং সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিকসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যায় ৫৫-৬০ শতাংশ জলমগ্ন হয়। এতে ১ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের ক্ষতি হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে এও বলা হয় দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ বন্যার উচ্চঝুঁকিতে আছে। এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে বলা হয়েছে এবং এ থেকে ভয়াবহ বিপর্যয়ও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
জলবায়ু অর্থায়নে ন্যায়বিচার ও সমতার জন্য বিপদের মুখে রয়েছে স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি)। মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে। এজন্য বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নের কাঠামোয় আমূল পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা। আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত সিআই ও নাকমের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত সাইড ইভেন্টে এ দাবি জানানো হয়। চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের (সিআই) জলবায়ু ঋণঝুঁকি সূচক ২০২৪ (সিডিআরআই) শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অনুদানভিত্তিক অর্থায়ন, শতভাগ ঋণমুক্তি এবং প্রকৃতিভিত্তিক অর্থনীতিই এ সংকট উত্তরণের মূল চাবিকাঠি। বাংলাদেশ ও মালাউই, যারা ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ তালিকায় রয়েছে, ক্রমবর্ধমান সিডিআরআই স্কোরের সম্মুখীন হচ্ছে, যা আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে। বিশেষত বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জলবায়ু ঋণের বোঝা ৭৯.৬১ মার্কিন ডলার, যা দেশের পরিবেশগত দুর্বলতার সঙ্গে অর্থনৈতিক ঝুঁকির অসামঞ্জস্যতা নির্দেশ করে। দেশের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই) স্কোর ২৮.৩৩, যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট চ্যালঞ্জেরে প্রতি উচ্চ সংবেদনশীলতার প্রতিফলন।
অন্যদিকে ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নাকম) গত দুই দশকে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সর্ম্পকিত অভিজ্ঞতার আলোকে তথ্য তুলে ধরেছে। সিডিআরআইয়ের যে জলবায়ু অর্থায়নের বড় একটি অংশ প্রশমন (মিটিগেশন) কার্যক্রমে কেন্দ্রীভূত, যেখানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়গুলোর জন্য অত্যাবশ্যক অভিযোজন প্রচেষ্টা উপেক্ষিত হয়েছে। এ বৈষম্য দূর করতে এবং এলডিসিগিলোর ভভিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে কাবন ট্যাক্স, সম্পদকর এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকি সংস্কারসহ শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড সংক্ষেপে জিসিএফ ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। অথচ তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ১০০ বিলিয়ন ডলারের। ২০২০ সালে শুরু করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রয়োজন ২০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ ২০১৪ সাল পর্যন্ত পেয়েছে মাত্র ৭১০ মিলিয়ন ডলার। এবার বাংলাদেশ এ তহবিল ১ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার দাবি করছে। কপ-২৮-এ বাংলাদেশ জলবায়ু অর্থায়নের পক্ষে কথা বলে। এতে অনেকটা সফলতা আসে। এবারের কপ-২৯-এ যেসব বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে সেগুলো হলো কার্বন নিঃসরণ কমানো, জীবাশ্ম জ্বালানি তেল-গ্যাস-কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা, জলবায়ুর ওপর শিল্পের প্রভাব কমাতে পারে এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, পুনরুৎপাদনযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ প্রভৃতি।
বাংলাদেশ এবার জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে কথা বলবে। অর্থাৎ উন্নত দেশগুলো অর্থায়ন করলে উন্নয়নশীল দেশ সবুজ জ্বালানি ব্যবহারে বিনিয়োগ যেমন করতে পারবে তেমন অভিযোজিতও হতে পারবে। এ ছাড়া ন্যায্য স্থানান্তর, জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি নিয়ে আলোচনা করবে। বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপের মতো দেশগুলো উন্নত দেশের কাছ থেকে এসব ন্যায্য জলবায়ু তহবিল সহায়তা পাবে, এটাই এখন সবার প্রত্যাশা।
শিক্ষক ও গবেষক
No comments:
Post a Comment