জীববৈচিত্র্য
অবহেলিত শহুরে বন্য প্রাণী
ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৪০ পিএম

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
যে বাস্তুতন্ত্রে মানুষ প্রধান সেই বাস্তুতন্ত্রে বেড়ে ওঠা বন্য প্রাণীকেই শহুরে বন্য প্রাণী বলা যায়। যদিও সব ক্ষেত্রে এ কথা খাটে না। এটা নির্ভর করে শহরে কোন প্রজাতিটি কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, কীভাবে তা উন্নয়নের মুখে পড়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তার ওপর। শহরে কোন প্রাণীগুলো প্রায়ই মানুষের সংস্পর্শে আসে, এটা যেমন শহুরে বন্য প্রাণীকে প্রতিনিধিত্ব করে, তেমন বনের জায়গায় যে প্রাণীগুলো মানুষের সংস্পর্শে আসছে তাদেরও আমরা শহুরে বন্য প্রাণী বলতে পারি। আরও স্পষ্ট করে বললে যে প্রাণীগুলো মানুষের দেওয়া খাবার খায়, যেমন পাখি ও পোষা প্রাণী, সর্বভুক প্রাণীও হতে পারে। এসব প্রাণী মানুষের অত্যাচার সহ্য করতে পারে। এরা তাদের আচরণ পরিবর্তন করতে পারে। এমনকি পরিবেশের বড় ধরনের সমস্যার মুখে পড়লেও অসুবিধা হয় না তাদের।
শহরে মানুষের সংস্পর্ষে বন্য প্রাণীর আসা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এ ক্ষেত্রে জনসাধারণকে বন্য প্রাণীর ওপর সহিংসতার বদলে ভালোবাসার জায়গা করে দিতে হবে। শহরের বাস্তুতন্ত্রে বেড়ে ওঠা বন্য প্রাণী যেসব সমস্যায় পড়ে তা হলো বন্য প্রাণীর থাকার জায়গা দিন দিন কমে যাচ্ছে, শব্দ ও আলোক দূষণের কবলে পড়ছে, রাসায়নিক দূষণ বেড়ে যাচ্ছে এবং বাস্তুতন্ত্র ভেঙে যাচ্ছে। শহরে বাদুড় প্রজাতি আলোকদূষণের কবলে পড়ছে। উভচর প্রাণী জলাভূমি হারিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। জলাভূমি থাকলেও জলাভূমিতে রাসায়নিক দূষণ উভচর প্রাণী ধ্বংস করছে। শহরে মানব-বন্য প্রাণী দ্বন্দ্ব কমানোর জন্য আমরা ময়লা-আবর্জনা রাখার জায়গা বন্ধ করে রাখতে পারি। পোষা প্রাণী রাতে ঘরে রাখতে পারি। রাতে ছাগল, ভেড়া, মুরগি এসব আবদ্ধ জায়গায় রাখতে পারি। অপরিকল্পিত উন্নয়ন বন থেকে আসা প্রাণীদের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে ৩৮টি সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে প্রায় ১ হাজার ৬১৮ কিমি রাস্তা রয়েছে।
দেশে অনেক রাস্তা, রেললাইন ও বৈদ্যুতিক খুঁটি বনের সংরক্ষিত এলাকায় রয়েছে। এসব কারণেও বন্যপ্রাণীর বিরাট একটা অংশ প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়ছে। একটি তথ্যমতে, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫টি বানর প্রজাতি শ্রীমঙ্গল প্রধান সড়কগুলো পার হতে গিয়ে মারা পড়েছে। আরেকটি তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ ও ২০১২ সালে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৭ কিমি রাস্তায় ৫০৩টি সাপ কাটা পড়েছে। কাঠবিড়ালি, খরগোশ, বাদুড়, রাজহাঁস, বিভিন্ন রকমের পাখি, ব্যাঙ, ইঁদুর, সাপ, কচ্ছপ এসব প্রাণী শহরে দেখা যায়। নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রাণী ও মানুষের সংঘর্ষ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ধূসর কাঠবিড়ালি যেসব শহরে থাকে তারা শব্দসংকেতের থেকে দৃশ্যসংকেত বেশি ব্যবহার করে। শহরে বাস করা কাঠবিড়ালি একে অন্যকে সতর্ক করে দেয় তাদের লেজ উত্তোলন করে। এ ক্ষেত্রে তারা শব্দসংকেত ব্যবহার করে না। শহুরে পাখির গানের আওয়াজ সমগোত্রীয় পাখির থেকে বেশি হয়। এরা অনেক জোরে গান গায়। প্রতিটি নগরাঞ্চল বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য বন্য প্রাণীও এখানে বিশেষ রকমের। শহরে মানুষ ও বন্যপ্রাণী সহজেই একসঙ্গে থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে শহুরে মানুষের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার আছে। যেহেতু পৃথিবীর চারপাশ এখন নগরায়ণের আওতায় এসে পড়ছে, সেহেতু নগরের বন্য প্রাণী নিয়ে আলাদা করে ভাবার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। এ মুহূর্তে নগরের বন্য প্রাণীদের তথ্য সংরক্ষণ করাটা জরুরি।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপকদের মধ্যে বোঝাপড়াও দরকার। কীটনাশক শহুরে বন্য প্রাণীর জন্য বিপজ্জনক হলেও আরও একটি বিষয় ভয়ানক রূপ নিচ্ছে। তা হলো প্লাস্টিক বর্জ্য। এখন মাঝে মাঝেই গরু-মহিষকে কোনো পাতলা প্লাস্টিক চাবাতে দেখা যায়। এমনকি অনেক পাখির বাসায় প্লাস্টিকের ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে। ডাম্পিং করা বর্জ্য খেয়ে অন্য বন্য প্রাণীদের মোটা হওয়া থেকে শুরু করে নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যাচ্ছে। শহরের খাবারের ওপর নির্ভর করে বন্য প্রাণীরা বিষাক্রান্তও হচ্ছে। কীটনাশক থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্যের কারণে তাদের সংখ্যা ও প্রজননে প্রভাব পড়ছে। মানুষের খাবারের ওপর নির্ভর করতে করতে এসব বন্য প্রাণী তাদের প্রাকৃতিক সহজাত বন্যপ্রবৃত্তি হারাতে বসেছে। নগরে প্রাণীদের বসবাস প্রাচীনকাল থেকেই। যদিও নগরে তাদের জীবন মোটেই নিরাপদ নয়। তারা এখানে সড়ক দুর্ঘটনা, পানির অভাব, তাপমাত্রার বৃদ্ধিজনিত সমস্যা, অবৈধ বন্য প্রাণী বিক্রির কবলে পড়ে প্রতিনিয়ত।
ভারত ও বাংলাদেশে বিশেষ করে মাছের বাজারে অনেক কাকের দেখা মেলে। জেলেরা মাছ রেখে কোথাও গেলে খুব দ্রুত কোনো একটা মাছ মুখে নিয়ে তারা চলে যায়। কিছু কাক ছোট মাছ মুখে নিয়ে উড়াল দেয়। এ ক্ষেত্রে বানর বেশ সাহসের সঙ্গে মানুষের থেকে খাবার কেড়ে নেয়। ভারতের শিমলায় বানরদের মোবাইল ফোনও নিয়ে নিতে দেখা যায়। খাবার না দিলে তারা মোবাইল ফোন ফেরত দেয় না। কোনো কোনো বানর খাবার চুরি করে। নগরে থেকে থেকেই বানরেরা খাবার জোগাড়ের এসব কৌশল রপ্ত করেছে। নগরে প্রতিদিন প্রচুর খাদ্যদ্রব্য ফেলা হয়। এসব ফেলে দেওয়া বর্জ্য পদার্থ অপব্যবহৃত হয়। অথচ এ ফেলে দেওয়া খাদ্য অনেক প্রাণীর বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে উঠতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে শহরে ডাম্পিং এলাকাগুলোয় অনেক প্রাণীর ভিড় দেখা যায় রাতে।
এ ধরনের শহুরে বন্য প্রাণী এখনও শহরে পাওয়া যায়। এমনকি ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোয়ও এসব বন্য প্রাণীর দেখা মেলে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, সম্পদ বিনষ্ট হতে রক্ষাকরণ এবং বন্য প্রাণী ও মানুষের একসঙ্গে বেঁচে থাকার স্বার্থে শহুরে বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করাটা এখন খুবই দরকারি। মানব-বন্য প্রাণী দ্বন্দ্ব শুধু বনে নয়, শহরেও সমানভাবে চলমান। উন্নয়নশীল শহরগুলোয় বন্য প্রাণীর ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রজাতি টিকে আছে। শহরে শুধু অনেক প্রজাতি টিকেই আছে না, মানুষের শত অত্যাচারের মাঝে নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টির মাধ্যমে তারা যথেষ্ট সহনশীলতা দেখাচ্ছে। নগরায়ণ মারাত্মকভাবে যে কাজটি করে তা
প্রাকৃতিক ভূমি ব্যবস্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। যে প্রজাতিগুলো টিকে আছে তাদের আরও কিছুটা জায়গা দিতে পারলে তারা সহজেই বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে শহরের পার্কগুলো একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। পার্কগুলো ব্যবহার করে বন্য প্রাণী সহজেই স্থানান্তরিত হতে পারে বা চলাচল করতে পারে, যা মানুষ অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় করতে বন্য প্রাণীর সমস্যায় পড়তে হয়। বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক চলাচল তাদের বংশবৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে পথ দিয়ে বন্য প্রাণী চলাচল করে তা রক্ষা করার মাধ্যমে শহুরে বন্য প্রাণী রক্ষায় ভূমিকা রাখা যায়।
শিক্ষক ও গবেষক
https://protidinerbangladesh.com/opinion/87230/%E0%A6%85%E0%A6%AC%E0%A6%B9%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%A4-%E0%A6%B6%E0%A6%B9%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A3%E0%A7%80?fbclid=IwAR0_AEhPR_bfNKnYFohTW3pqlIRCMDqucYeZFa4EFB9SzBPG38QH8J_BCAU