অবৈধ ইটভাটা কি বন্ধ হবে না
ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৫১ এএম|প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের বায়ুদূষণের পরিমাণ এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুজনিত নানা রোগ। কমে যাচ্ছে মানুষের গড় আয়ুও। একদিকে যেমন নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ ও জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে দ্রুত, অন্যদিকে বাড়ছে শ্বাসকষ্ট। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এ বায়ুদূষণ যেটা বাড়ছে সেটা আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকছে না। দূষণ হয়ে যাচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি। এর প্রভাব পড়ছে বেশি। এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের ২০২৩ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা ৭৪ মাইক্রোগ্রাম। একই সময়ে ভারতে ৫৮.৭ মাইক্রোগ্রাম ও চীনে ৩০.২ মাইক্রোগ্রাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের ২০২১ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর কমপক্ষে ৬.৮ বছর করে আয়ু কমে যাচ্ছে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের তথ্যমতে, বিশ্বে দূষণের তালিকায় শীর্ষে এখন ঢাকা। সংস্থা অনুযায়ী, শহরটির এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর এখন ২৮০। পাকিস্তানের লাহোরের স্কোর ২৩৪, ভারতের দিল্লির স্কোর ২২৪ এবং কলকাতার স্কোর ১৯০। অর্থাৎ বায়ুদূষণের দ্বিতীয় শীর্ষে লাহোর, তৃতীয় শীর্ষে দিল্লি এবং চতুর্থ শীর্ষে ছিল কলকাতা। উল্লেখ্য, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের ১০১ থেকে ১৫ স্কোরকে সংবেদনশীলদের জন্য অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ স্কোরকে অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ স্কোরকে খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১ থেকে ৪০০ স্কোরকে গুরুতর অস্বাস্থ্যকর ধরা হয়।
ক্লিন এয়ার ফান্ডের একটি তথ্যমতে, স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটি ফান্ডিং ২০২৩-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বায়ুর গুণগত মান উন্নয়নের তহবিল প্রাপ্তিতে তৃতীয় ছিল বাংলাদেশ। এতে আরও বলা হয়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বায়ুর মান উন্নয়নে বাংলাদেশ ২.৪ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। আরও একটি তথ্য অনুযায়ী, শীতকালে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি এবং অস্বাস্থ্যকর হলেও বর্ষাকালে দূষণ একটু কম থাকে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি কারণ হলো ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণকাজে সৃষ্ট ধোঁয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে আনুমানিক ৩০ লাখ মানুষ মারা যায়। এসব বায়ুদূষণের কারণে মূলত স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগ, শ্বাসযন্ত্রের নানাবিধ সংক্রমণ হতে পারে। ঢাকার নিকটবর্তী গাজীপুর দেশের সবচেয়ে দূষিত জেলা। এখানকার মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে ৮.৩ বছর।
সরকার বায়ুদূষণ রোধে বিশেষ পরিকল্পনায় কাজ করে যাচ্ছে। কোনো এলাকায় বায়ুদূষণ বেড়ে গেলে সরকার এটাকে ডি-গ্রেডের এয়ার শেড ঘোষণা করে। তখন ওই এলাকায় কোনো ইটভাটা থাকলে তা বন্ধ করে দেওয়া বা অন্য কোনো দূষণকারী বিষয় থাকলে তা বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শিল্পকারখানা দূষণের উৎস হলে তা বন্ধ করে দেওয়া বা অন্য কোনো পরিকল্পনায় শিল্পকারখানা চালানো যায় কি না, তার জন্য চাপ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ইটের বিকল্প হিসেবে অপোড়ানো ব্লক ব্যবহারের ব্যাপারে সরকার এগিয়ে আসছে। ইটের বিকল্প হিসেবে অপোড়ানো ব্লক ব্যবহার একটি ভালো পরিকল্পনা। এর শতভাগ ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা ২০২৫ সাল ধরা হলেও বাস্তবতা বিবেচনায় ২০২৯ সাল ধরা হয়েছে। বাংলাদেশে বায়ুদূষণে প্রতি বছরে ৮০ হাজার মানুষ মারা যায়। বাড়ছে বিষণ্নতা। এ ছাড়া বায়ুদূষণের কারণে জিডিপির চার ভাগেরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বায়ুদূষণজনিত সমস্যায় ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষ মারা গেছে। ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার বায়ুদূষণ রোধে সাড়ে ছয় কোটি মার্কিন ডলারের দুটি প্রকল্প হাতে নেয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২৫ কোটি ডলারের আরও একটি প্রকল্প রয়েছে।
বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উপাদান বাতাসে পিএম বা অতি ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি। ২০২৩ সালে বাতাসে পিএম বা অতিক্ষুদ্র বস্তু কণার পরিমাণ পাওয়া গেছে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের চেয়ে ১৬ গুণ বেশি। বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস সময় পর্যন্ত দূষণের মাত্রা এত থাকে যে, এটি সারা বছরের প্রায় ৬৫ শতাংশ।
এসব ভয়াবহ বায়ুদূষণের অন্যতম তিনটি প্রধান কারণের একটি ইটভাটা। বাংলাদেশে যত্রতত্রই ইটভাটা রয়েছে। একটি তথ্যমতে, এর সংখ্যা প্রায় আট হাজার। আর এর অর্ধেকই অবৈধ। অবৈধ ইটভাটা বন্ধে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ উচ্চ আদালতে বেশ কয়েকটি রিট করেছে। এতে কিছুটা সফলতা এলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি। ইটভাটার কারণে শুধু বায়ুদূষণই হচ্ছে না, ইট তৈরির জন্য মাটির প্রয়োজন পড়ে। ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে ইট তৈরি করা হচ্ছে। ফসলি ক্ষেতের মাটির ওপরের অংশেই মূলত সার থাকে। কৃষকরা না বুঝে মুনাফার লোভে মাটি বিক্রয় করে দিচ্ছেন। এতে ফসলি জমির ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে হাজারেরও বেশি ইটভাটা রয়েছে যেখানে সনাতন পদ্ধতিতে কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করা হয়। এতে অসংখ্য কাঠের প্রয়োজন পড়ে, যা গাছ কেটে জ্বালানি তৈরি করা হয়। ইটভাটার জন্য এভাবে অসংখ্য গাছ কাটার কারণে পরিবেশের ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে।
ইটভাটায় বায়ুদূষণ রোধে ২০১৭ সালে একটি জাতীয় টেকসই কৌশল প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু এতে আমরা পরিবেশ দূষণ রোধ তো করতেই পারছি না বরং এখনো অবৈধভাবে চলছে ইটভাটা। ইটভাটা এখন মফস্বল শহর, গ্রামগঞ্জে যত্রতত্র নির্মাণ করা হচ্ছে। শুধু ঢাকা নয়, গ্রামেও ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় গাছপালা মানুষসহ পশুপাখি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করলেও বা বন্ধ ঘোষণা করলেও দেখা যাচ্ছে আবার ইটভাটা চালু হচ্ছে। প্রকৃতির অন্যতম দুটি উপাদান মাটি আর গাছপালা দুইয়েরই বিনষ্ট করে চলেছে ইটভাটাগুলো। ইট যেমন সভ্যতা নির্মাণের প্রতীক, ঠিক তেমনি ইটের সভ্যতার নিচে চাপা পড়ে আছে গাছের রক্ত আর মাটির দাগ। ইটের নিচে চাপা পড়া এসব হলুদ হয়ে যাওয়া মাটি আর গাছগুলোকে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই। তাই অবিলম্বে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। তা না হলে একদিন ইটের নিচে চাপা পড়ে যাব আমরাই।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক