7/15/2024

বাংলাদেশ কি ডুবে যাবে? ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

বাংলাদেশ কি ডুবে যাবে?

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
🕐 ৯:০০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৫, ২০১৯


বাংলাদেশ এমন একটি বদ্বীপ, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে খুব একটা উঁচুতে নয়। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত রয়েছে বাংলাদেশে, যা ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ। বিজ্ঞানীরা আগে পানির স্তর যতখানি বৃদ্ধির কথা ভেবেছিলেন, বর্তমানে তারা আরও অধিক উচ্চতায় থাকবেন বলে ধারণা করছে। পৃথিবীতে ২০ লাখ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাপ বেড়ে যাবে।


প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮৮০ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০৩০ সালে এটি বেড়ে হতে পারে ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০৫০ সালে এটি ৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে।

ওয়ার্ল্ড মিটিয়েরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট ও ক্লাইমেট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, ১৯৯৮ সাল ছিল উষ্ণতম এবং ২০০৫ সাল দ্বিতীয় উষ্ণতম বছর। এভাবে উষ্ণতা বাড়লে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাবে। সবচেয়ে বেশি উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯২০ থেকে ১৯৪৫ এবং ১৯৭৬ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে।

বিজ্ঞানীদের মতে, আগামী ১০০ বছরের মধ্যে মেরু অঞ্চলের সমস্ত বরফ পানিতে পরিণত হবে। গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রভাবে সমুদ্রের স্তর ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার বেড়ে যাবে। এতে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বাড়বে। ফসলের ক্ষেতসহ বনাঞ্চল ধ্বংস হবে। বিশ্বজুড়ে খাদ্যাভাব দেখা দেবে।

২০১৩ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী সমুদ্রস্তরের উচ্চতা ৫২ থেকে ৯৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়বে। কিন্তু বর্তমান গবেষণায় বলা হচ্ছে, এটি ৬২ থেকে ২৩৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর তাপমাত্রা এখানকার চেয়ে আরও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। ২০৫০ সালে মধ্যে ২ কোটি মানুষ ও ২১০০ সালের মধ্যে এক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।

পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বরফ গলে যাচ্ছে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যেমন বাড়বে তেমনি বাড়বে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসও। জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে, যার জন্য গ্রিন হাউস গ্যাসকে দায়ী করা হচ্ছে। গ্রিন হাউস হচ্ছে এক ধরনের কাচ ঘর। শীতপ্রধান দেশে সবজি তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। এতে সৌরকিরণ প্রবেশ করলেও আর বেরুতে পারে না। পৃথিবীটাও বর্তমানে গ্রিন হাউসের মতো আচরণ করছে। অর্থাৎ এতে যে পরিমাণ সূর্যতাপ ঢুকছে, তা আর বেরুতে পারছে না। কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস, মিথেন, নাইট্রোজেন অক্সাইড, জলীয় বাষ্প প্রভৃতি তাপমাত্রাকে ধরে রাখছে।

এভাবে তাপমাত্রা আটকে গিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে, একেই বলে গ্রিন হাউস ইফেক্ট। গ্রিন হাউস গ্যাস হলো কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, ওজোন, মিথেন ইত্যাদি। কাবন ডাই অক্সাইডের উৎস হলো বন পুড়ে যাওয়া, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি। মিথেন গ্যাসের উৎস হলো জলাভূমি, প্রাকৃতিক গ্যাস। ওজোন সূর্যের আলো থেকে সৃষ্ট। এসব গ্যাস বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, জীবাশ্ব জ্বালানির পরিমাণ বৃদ্ধি, রাসায়সিক সারের ব্যবহার বৃদ্ধি, বন ধ্বংসকরণ।

শিল্প বিপ্লবের কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এর মাত্রা প্রায় ১৪২ শতাংশেরও বেশি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের হার বেশি। চীন প্রায় ৩০ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করেছে প্রায় ১৭ শতাংশ।

পোল্যান্ডের জলবায়ু সম্মেলনে প্রকাশিত জরিপ মতে, ২০১৮ সালে ২ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়েছে। পূর্বের বছরের তুলনায় এটি এক দশমিক আট শতাংশেরও বেশি। এই জরিপে আরও বলা হয়- ২০১৭ সালে চীন ২৭ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ১৫ শতাংশ, ভারত ৭ শতাংশ গ্যাস উৎপন্ন করেছে।

বিশ্বের সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হলো তিনটি। ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৭ সালে ৫৮ শতাংশ গ্যাসই এরা উৎপন্ন করে। ২০১৬ সালে বিগত ৮ লাখ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে জমা হয়েছে।

বিশ্বের ৫১টি দেশের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ডব্লিউএমও জানায়, ২০১৬ সালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস মেশার গড় হার ছিল ৪০৩.৩ পিপিএম। বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল অ্যাটলাস শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, ২০১৫ সালে ৩৬,২৬২ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরিত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে চীন, যার পরিমাণ ১০,৩৫৭ টন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত ৫,৪১৪ টন এবং বাংলাদেশ ৭৭ টন।

প্রসিডিংস অব দি ন্যাশনাল একাডেমিক সায়েন্সেসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এভাবে কার্বন নিঃসরণ বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের মতো বদ্বীপ, নীল নদের বদ্বীপসহ লন্ডন, নিউইয়র্ক এবং সাংহাইয়ের মতো অনেক শহর বিলীন হয়ে যাবে। ২১০০ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬২ থেকে ২৩৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়লে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৮০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার ভূমি পানিতে তলিয়ে যাবে।

ন্যাচার কমিউনিকেশন নামের যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত একটি জার্নালে বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ ভূমি পানিতে ডুবে যাওয়ার আশংকা করা হয়েছে। ২০১০ সালে জার্মান ওয়াচের প্রকাশিত ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সে জলবায়ু পরিবর্তনের পৃথিবীর যে দশটি দেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার প্রথমেই রয়েছে বাংলাদেশ।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, ২০৩০ সালে এ দেশে পানি ও মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়বে। এতে বাংলাদেশ ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ জমি সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। উপকূলীয় এলাকার ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে গবেষকরা সতর্ক করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হবে, যেখানে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোকের বসবাস। সমুদ্রের লবণাক্ত পানির কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে। নদীতটের মানুষ ঘরহারা হবে।

১৯৯৭ সালের ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের উদ্যোগে কিয়াটো প্রটোকল গৃহীত হয়, যার লক্ষ্য ছিল কার্বন নির্গমন হ্রাস। এই প্রটোকল অনুযায়ী, ২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ৫ শতাংশ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর জন্য প্যারিসের লো বুর্জে ১৯৫টি দেশের একটি সমঝোতা হয়। এই সম্মেলনে বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই প্যারিস চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ায় অনেক সমালোচনা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের এই হটকারিতা বিশ্বকে কোন দিকে নিয়ে যাবে। এই অবস্থায় ভয়াবহ সংকটে পড়বে পুরো বিশ্ব। ডব্লিউএমওর মতে, ৭০ বছরে ১০০ গুণ বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে মিশেছে।

এই অবস্থায় সম্প্রতি ২০৩০ সালের মধ্যে ২০১০ সালের তুলনায় গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন ৫ শতাংশ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশে কার্বন নিঃসরণ জ্বালানি, শিল্প ও পরিবহন এই তিনটি খাতে কমানোর কথা বলেছে।

বিদেশি সাহায্য পেলে এটি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও অপরিকল্পিত ভূমির ব্যবহার, ওজোনস্তরের ক্ষয়, বন উজাড়করণের মতো ঘটনাগুলো ঘটছেই। এদিকে ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)র প্রতিবেদন অনুযায়ী কার্বন নিঃসরণ কমাতে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা ভালো। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসার ঘটানোর কাজ হাতে নিয়েছে। বেসরকারি সংস্থা গ্রামীণ শক্তির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত ৪৫ লক্ষ সোলার সিস্টেম বসানো হয়েছে যার মধ্যে ১৭ লক্ষ সংস্থাটির। এই ধরনের জ্বালানি কার্বন নিঃসরণ করবে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে যে ধরনগুলো দেখা যাচ্ছে তার প্রভাব বাংলাদেশে স্পষ্ট। সত্যিকার অর্থে এখন আমাদের কাজ বাংলাদেশকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করা। এই অবস্থায় কার্বন নিঃসরণ কমাতে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। বিশ্ববাসীকেও এগিয়ে আসতে হবে।

বিভূতি ভূষণ মিত্র : গবেষক ও কলাম লেখক
bhushan.bibhutimitra@gmail.com



https://www.kholakagojbd.com/prints/40701