3/04/2024

টাঙ্গুয়া হাওরের সুরক্ষা জরুরি ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 

টাঙ্গুয়া হাওরের সুরক্ষা জরুরি

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

প্রকাশ : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:১৭ এএম

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

টাঙ্গুয়া হাওর। প্রথমেই বলে নিচ্ছি এটি টাঙ্গুয়ার নয়, টাঙ্গুয়া। স্থানীয়রা একে টাঙ্গুয়া হাওরই বলেন। সরকারি নামজারিতেও এটি টাঙ্গুয়া নামে পরিচিত। অনেকের মতে, বাঁশের টং বানিয়ে কৃষকরা ধান পাহারা দিতেন। এখান থেকেই টাঙ্গুয়া নামটি এসেছে। এ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার শিক্ষক ড. মো. মোস্তফা ফিরোজের সঙ্গে কথা বলি। তিনি আরও জানালেন আইইউসিএন-এর প্রজেক্ট প্রোপোজালে এই টাঙ্গুয়া হাওরের নাম টাঙ্গুয়ার হাওর লেখার পর এটি টাঙ্গুয়ার হাওর নামেই সব জায়গায় পরিচিতি পেতে থাকে। সত্যিকার অর্থে এটি এখন আর টাঙ্গুয়া হাওর নাই। নতুন আরেক টাঙ্গুয়ার হাওরই হয়ে গেছে। একসময় জীববৈচিত্র্যের লীলাভূমি ছিল টাঙ্গুয়া হাওর। পাওয়া যেত ১৪১ প্রজাতির মাছ, যার মধ্যে মাগুর, বাইম, গুলশা, চিতল, কালবাউশ, ট্যাংরা, গজার, বেতি, কাকিয়া অন্যতম। নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদও এদের বিশেষ সৌন্দর্যকে ধরে রেখেছে। যেমন হিজল, হেলেঞ্চা, পানিফল, নলখাগড়া, শালুক, শাপলা ইত্যাদি। এখানে শীতকালে ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখিও আসে। এ ছাড়া ১৩ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির বিলুপ্ত কচ্ছপ, সাত প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ ও ২৬ প্রজাতির বিভিন্ন বন্যপ্রাণী রয়েছে।



টাঙ্গুয়া হাওরকে মাদার অব ফিশারিজ বলা হলেও এখন তা অতীত হতে চলেছে। কেননা এসবের অনেক কিছুই আগের মতো নেই। টাঙ্গুয়া হাওর সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় অবস্থিত। ওখানে ১৮টি মৌজা ও ৫১টি জলমহাল রয়েছে। এর আয়তন ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর। এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। এটি স্থানীয়ভাবে নয়কুড়ি কান্দার ছয়তুড়ি বিল নামে পরিচিত, যেখানে ৭৪টি বিল রয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম রামসার স্থান সুন্দরবন, এরপরই এই হাওর। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরনা এসে এখানে মিশেছে। ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি এটি রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। টাঙ্গুয়া হাওরটি জলমহাল হিসেবে আগে ইজারা দেওয়া হতো। ১৯৯৯ সালে একে সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার ভেতর দিয়েই ইজারা প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয় জেলা প্রশাসন। হাওরে ৮৮টি গ্রামে ৬০ হাজারের মতো মানুষ বসবাস করে। প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক বর্জ্য, অতিমাত্রিক মৎস্য আহরণ, আগাছা নাশ, বন উজাড়, মাটি ক্ষয় এবং প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে হারাতে বসেছে অপরূপা এই হাওরের সৌন্দর্য। 

টাঙ্গুয়া হাওরকে পর্যটক আকর্ষণ করার অন্যতম কারণ হলো ওখান থেকেই অদূরের মেঘালয় পর্বত। এখানকার স্বচ্ছ পানি, অসংখ্য পাখি ও হিজল করচ বন একটা আলাদা সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে হারিয়ে যাওয়া এবং মাছের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় হাওরের মানুষের জীবন-জীবিকাও হুমকির মুখে পড়েছে। ২০ বছর আগেও এই হাওরে পাখি আসত ৫ লাখ। এখন তা কমে ১ লাখে এসেছে। ১৩৫ প্রজাতির মাছ ও ২৫০ প্রজাতির পাখি এ অঞ্চলে দেখা যায়। প্রতিবছর এখানে শীতকালে হিমালয়, চীন ও সাইবেরিয়া থেকে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আসে। ২৫০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৩০ প্রজাতির বুনো হাঁসের দেখা মেলে। এ ছাড়া বালিহাঁস, গাঙচিল, পানকৌড়ি বেগুনি কালেম, ডাহুক, বক, সারস, কাক, শঙ্খচিল রয়েছেই। বিরল পাখির মধ্যে রয়েছে লাল ঝুটি, ল্যাঞ্জা হাঁস, খুন্তে হাঁস, নীল মাথা হাঁস, টিকি হাঁস, ধলা বালি হাঁস, পান মুরগি, সরালি, রাজ সরালি, পাতি মাছরাঙা, চখাচখি ইত্যাদি। এখানে ২০০ প্রজাতির জলজপ্রাণী যেমন রয়েছে, তেমনি কমপক্ষে ১৩৫ প্রজাতির মাছও রয়েছে। চিতল, কালবাউশ, মাগুর, বাইম, তারা বাইম, ট্যাংরা, তিতনা, গজার, গরিয়া এসব মাছের দেখা মিলে। 

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের জরিপ মতে, ২০১৮ সালে ৬০ হাজার পাখি গণনা করা হলেও এখন তা ২৭ হাজারে নেমে এসেছে। মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার মূল কারণ মনুষ্যসৃষ্ট পরিবেশদূষণ। মাছ ধরার অবৈধ জাল, মাছের পোনা আহরণ, নৌকার কারণে নানাবিধ দূষণ, কুষিতে কীটনাশক ব্যবহার মাছের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। মাছের ৫৪টি বিলের মধ্যে মাত্র ১২টি বিল মাছ ধরার জন্য নিষিদ্ধ করা হলেও অনেকের তথ্য মতে, সেখানেও জেলেদের মাছ ধরতে দেখা যায়। টাঙ্গুয়া হাওরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য জলজ গাছপালা। এটিও হারাতে বসেছে দিন দিন। হাওরের তীর ঘেঁষে হিজল ও করচগাছ দেখা যায়। এসব গাছে মাছ ও পাখপাখালি আশ্রয় নেয়। কৃষিজমি বৃদ্ধি ও জ্বালানির কারণে এসব গাছ কাটা হচ্ছে। 



স্থানীয়রাই বিলের মাছ খেতে পারেন না। তাদের থালায় দেখা যায় চাষের মাছ। পর্যটন একটা সমৃদ্ধি আনলেও পরিবেশগত কারণে এটি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। পর্যটকরা বিশেষ করে যারা রাতে থাকছেন তারা বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন অনেক কিছু নিষিদ্ধ করলেও তারা তা মানছেন না। বেশ কিছুদিন আগে হাওরে ১২টি শর্তে চলাচলের জন্য নৌযান নিবন্ধন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নৌযানগুলোতে নিবন্ধনপত্র থাকবে। এগুলো তারা সংরক্ষণ করবে এবং তা হস্তান্তরযোগ্য নয়। নিবন্ধনপত্র একটি নির্দিষ্ট সময় পর নবায়ন করার কথা বলা হয়েছে। ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থ নদী-হাওর-বিল-পুকুরে ফেলতে নিষেধ করা হয়েছে। নৌযানে সংরক্ষিত ঢাকনাযুক্ত বড় ডাস্টবিনে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে বলা হয়েছে। নৌযানে কোনো লাউডস্পিকার, মাইক এ রকম উচ্চ শব্দ উৎপাদনকারী কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। পর্যটকদের মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং কোনো অসামাজিক ও অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। স্থানীয় এলাকাবাসী সামাজিক রীতিনীতি বিষয়ে শ্রদ্ধাশীল কিন্তু আরোপিত ১২টি শর্তের কোনোটাই তেমন মানা হয় না।

কঠোর নীতিমালা ও এর প্রয়োগ ব্যতীত এই প্রকৃতির অপরূপকে বাঁচিয়ে তোলা অসম্ভব। এ মুহূর্তে পর্যটন ও পরিবেশে ব্যবস্থাপনার একটা সমন্বয় প্রয়োজন। এখন মাত্র ২৪ জন আনসার গোটা হাওর পাহারা দেন, যা খুবই অপ্রতুল। যেখানে আগে ৫০০-এর বেশি ইজারাদার পাহারাদার ছিলেন। এটি প্রায় ৫০ বছর ইজারাদারদের হাতে ছিল। বলতে গেলে ইজারাদারদের হাতে থাকাকালেও হাওর এতটা হুমকির মুখে পড়েনি। এই অবস্থায় স্থানীয় জনগণ সঙ্গে নিয়ে অংশীদারত্বের মাধ্যমে আবার নতুন করে হাওর বাঁচানো সম্ভব। ফলে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে হাওরের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। স্থানীয় জনগণকে পরিবেশ ও হাওর বাঁচানো কতটা প্রয়োজন তার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। স্থানীয়রা যদি সংরক্ষণের গুরুত্ব না বুঝেন ও সংরক্ষণ না করে বাইরে থেকে কেউ পাহারা দিয়ে হাওর রক্ষা করতে পারবেন না।

শিক্ষক ও গবেষক



https://protidinerbangladesh.com/opinion/89157/%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BF