6/10/2024

রোহিঙ্গা সংকট ও পরিবেশ বিপর্যয়

 রোহিঙ্গা সংকট ও পরিবেশ বিপর্যয়

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে একটি উদার ও মানবিক রাষ্ট্রের পরিচয় দিয়েছে। মানুষের পাশে অবশ্যই মানুষের দাঁড়ানো উচিত। সরকার তাদের দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।


বাংলাদেশে ২০১৭ সালের আগস্টের মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। বর্তমানে এর সংখ্যা আনুমানিক ১১ লাখ। সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের জন্য ৬ হাজার একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে। বাংলাদেশের বনভূমি, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর বিরাট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।

ইউএনডিপি বাংলাদেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে ২০১৮ সালে একটি কাজ করেছিল। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী কক্সবাজার এলাকায় তখন প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছিল। এ সময় প্রায় ৪৩০০ একর পাহাড় ও বনাঞ্চল কেটে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়। প্রতিবেদন মতে, এখানকার ১৫০২ হেক্টর বন এখন সংকুচিত হয়ে ৭৯৩ হেক্টরে নেমেছে। টেকনাফ-উখিয়া-হিমছড়ির প্রায় ৩০০০ থেকে ৪০০০ একর পাহাড়ি এলাকা বাগানের জন্য পরিষ্কার করা হয়েছে। যে হারে জ্বালানি কাঠ কাটা হচ্ছে তাতে ২৫ হাজার একর বনভূমি বছরে উজাড় হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী ১ মাসে ৬৮০০ টন জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করা হয় এবং প্রতিদিন প্রতিটা রোহিঙ্গা পরিবার ৬০টি বাঁশ ব্যবহার করে। কয়েক হাজার টিউবওয়েল সেখানে স্থাপন করা হয়েছে, যা জলের স্তরের ওপর প্রভাব ফেলছে। জ্বালানি ব্যবহারের কারণে বায়ুদূষণ বেড়েছে। বনের ক্ষয়ের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছাড়া অন্যান্য জায়গার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে বন ও বনের জীবজন্তুর ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে। অনুমান করা হচ্ছে দিনে সেখানে ৩ থেকে ৫টি ফুটবল খেলার মাঠের সমান বন ধ্বংস হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে টেকনাফ ওয়াইল্ডলাইফ সেঙ্কচুয়ারি, হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান ও ইনানি সংরক্ষিত বনও এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এখানে প্রতিদিন কাঠ কাটা থেকে শুরু করে বনের নানা সম্পদ তারা ধ্বংস করছে। টেকনাফ ওয়াইল্ডলাইফ সেঙ্কচুয়ারি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে হাতির সংখ্যা বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আছে। এ অবস্থায় হাতি ছাড়াও এখানকার অন্য প্রাণীরা বিপদসংকুল হয়ে পড়েছে।

এ ছাড়া কুতুপালং ক্যাম্পে বন্য হাতির তা-বে ১১ জনের মৃত্যু ও অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কুতুপালং ক্যাম্পটি প্রাচীনকাল থেকেই পরিব্রাজক পথ হিসেবে হাতি ব্যবহার করে আসছে। সেই পথে এখন হাতির যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের মতে ক্যাম্পে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের সরবরাহ করা হলে জ্বালানি হিসেবে গাছ কাটার প্রবণতা কমবে। রোহিঙ্গা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্যের বিষয়টিও সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র : গবেষক ও কলাম লেখক
bhushan.bibhutimitra@gmail.com

https://www.kholakagojbd.com/prints/35751 

আমাজনের আগুন ও বাংলাদেশের বন ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র



আমাজনের আগুন ও বাংলাদেশের বন

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
🕐 ৯:৩৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯

 


 


 




আমাজন বন পৃথিবীর আটটি দেশের ওপর অবস্থিত। এটি দক্ষিণ আমেরিকার ৪০ ভাগ এলাকাজুড়ে রয়েছে এবং একে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ বলা হয়। পৃথিবীর ২০ ভাগ অক্সিজেনের জোগান দেয় এই বন। পৃথিবীর ১০টি প্রাণী প্রজাতির মধ্যে একটি বাস করে আমাজনে। ব্রাজিলের প্রায় ৬০ ভাগ সীমান্তজুড়ে আমাজন বন দেখা যায় বা ব্র্রাজিলের প্রায় ২ দশমিক ১ মিলিয়ন বর্গ মাইলজুড়ে এই বন। এটি কার্বনের আধার আর সবচেয়ে বৃহৎ জীববৈচিত্র্যের বাসভূমি।


বিশ্বের শতকরা ২০ ভাগ অক্সিজেন তৈরি হয় এখানে। আমাজন না থাকা মানে শতকরা এই ২০ ভাগ অক্সিজেন না থাকা। এর ফলে অনেক প্রাণী প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। পৃথিবীতে প্রতি বছর যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ঘটে তার ২ দশমিক ২ বিলিয়ন টন শুষে নেয় এই বন। আমাজনে ১৬ হাজার প্রজাতির ৩৯০ বিলিয়ন গাছ-গাছালি আছে। এখানে ৪৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড়, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। এছাড়া আমাজন নদীতে তিন হাজার প্রজাতির মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী আছে।

আমাজন থেকে মানুষসহ পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই উপকৃত হয়। এর গাছগুলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে আর অক্সিজেন ত্যাগ করে। কিন্তু পৃথিবীর ফুসফুস-খ্যাত এই বনের গাছকাটা, মাটি খনন ও কৃষি ব্যবসার জন্য উজাড় হচ্ছে। আমাজনে জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে শুষ্ক আবহাওয়া শুরু হয়। এ সময় আগুন লাগার ঘটনা বেশি ঘটে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চের মতে, এ বছর ৮০ হাজারেরও বেশি বার আগুন লেগেছে। আগের বছরের তুলনায় এটি প্রায় ৮০ ভাগ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে এই আগুন লাগার মূল কারণ বন উজাড় হয়ে যাওয়া।

সায়েন্স ম্যাগাজিনে পাওলো আর্টেক্সো নামের একজন আবহাওয়াবিদ বলেছেন- আমাজনে যেখানেই নতুন কৃষিভূমি হচ্ছে সেখানেই আগুন লাগছে। বিজ্ঞানীদের মতে আমাজন যদি সাভানার মতো হয়, তাহলে এই ঘন বর্ষণ বনাঞ্চল থাকবে না। তাপমাত্রা বৃদ্ধি শুষ্ক মৌসুমে খরা বৃদ্ধি করে। এতে করে অনেক গাছপালাও মারা যাবে। খরা হলে সেখানকার মাছ, জল আর ডলফিন কমতে থাকবে। স্থানীয় আদিবাসীরা টিকে থাকতে পারবে না।

ব্রাজিলে বনের আগুন দূষণ বাড়িয়েছে। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডসহ বিভিন্ন উপাদান মিশে যাচ্ছে। বিপুল পরিমাণ কার্বন যোগ হয়েছে। এ বছর ২২৮ মেগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে মিশেছে।

বিবিসির প্রতিবেদন মতে ব্রজিলের উত্তরাঞ্চলে দাবানল বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে রোরাইমারিতে ১৪১ শতাংশ, রোনডোনিয়াতে ১১৫ শতাংশ এবং আমাজোনাসে ৮১ শতাংশ দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। ইনপের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী জুলাই মাসঅব্দি সেখানে ৭২ হাজারেরও বেশি আগুন লেগেছে। ২০১৮ সালে আগুন লাগার ঘটনা ছিল ৪০ হাজারের কম।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের মতে, বন উজাড় হয়ে যাওয়াই অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ। বিবিসি এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে বলছে, ব্রাজিলের তিনটি সংরক্ষিত এলাকা যেখানে নৃগোষ্ঠীর বসবাস, সেখানে সোনা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে অবৈধ খনন চলছে।

এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৪ হাজার ৫৬৫ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে বন উজাড় বেশি হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭ লাখ বর্গ কিলোমিটার বন ধ্বংস হয়েছে। এজন্য বন উজাড় হচ্ছে। এক প্রতিবেদন মতে ২০০৪-২০০৫ সাল পর্যন্ত আমাজন বনের প্রায় ১৭ শতাংশ ধ্বংস করা হয়। পরে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে এর ১০০ ভাগের ৮৩ শতাংশ ক্ষতি কমানো হয়। আমাজনে ৩০ লাখ প্রজাতির গাছপালা আর প্রাণী রয়েছে। আদিবাসী বাস করে প্রায় ১০ লাখ।

এ অবস্থায় আমরা পৃথিবীবাসী জনপ্রিয় অভিনেতা লিওনার্দো ডি-ক্যাপ্রিওকে অনুসরণ করতে পারি, যিনি আমাজন সংরক্ষণে বিশাল অঙ্কের অর্থ সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছেন। রেইন ফরেস্ট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক, রেইন ফরেস্ট ট্রাস্ট, আমাজান ওয়াচ অথবা রেইন ফরেস্ট এলায়েন্সের মতো সংগঠন কাজ করছে আমাজন রক্ষায়। আমরা পরিবেশবাদীরা সরকারকে আরও কিছু করার জন্য চাপ দিতে পারি। সম্প্রতি জি-৭ ঘোষণা করেছে তারা কমপক্ষে ২০ মিলিয়ন ইউরো দান করে আমাজন বন সংরক্ষণে সাহায্য করবে। এ ছাড়া কোম্পানিগুলো যেসব পণ্য উৎপাদন করছে তার যেন পরিবেশ সনদ থাকে সেদিকেও সচেতন হতে হবে।

আমাজনে আগুন লাগার অন্যতম যে কারণটি বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করেছেন, সেই বন উজাড় হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশেও হরহামেশা হচ্ছে। দেশে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে তা ক্রমে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের বন এখন ১৭ ভাগের নিচে। বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেন্সিং অর্গানাইজেশন ও বন বিভাগের ২০০৭ সালের অপ্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে মাত্র ৭ দশমিক ২৯ ভাগ (১ দশমিক ০৮ মিলিয়ন হেক্টর) বনাঞ্চল রয়েছে।

বাংলাদেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ ২৬ লাখ হেক্টর। দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ বনভূমি। বন অধিদফতর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের আয়তনের ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বর্তমানে দেশের মোট আয়তনের মাত্র ১৩ দশমিক ২৮ শতাংশ এলাকা বৃক্ষ আচ্ছাদিত। বনভূমির ৩৮ দশমিক ৭১ শতাংশ প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন, ৩০ শতাংশ পাহাড়ি বন, ১১ দশমিক ৪২ শতাংশ সৃজিত ম্যানগ্রোভ বন, শাল বন ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ ও জলাভূমির পরিমাণ ১ দশমিক ৭১ শতাংশ।

এফএওর ২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের বনভূমি ছিল ১৪ লাখ ৯৪ হাজার হেক্টর। ২০১৫ সালে তা কমে হয়েছে ১৪ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম বন পাকিস্তানে। এরপরই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে ১৭টি দেশে কৃষি ও বনভূমি কমেছে। বাংলাদেশ রয়েছে এর শীর্ষে।

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও বনবিভাগ বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা নিয়ে একটি গবেষণা করে। ওই গবেষণা মতে, ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বনের বাইরে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর এলাকা বেড়েছে। গবেষণায় এও জানা যায়, তিন পার্বত্য জেলায় ৮০ হাজার ৮০০ হেক্টর বন উজাড় হয়েছে।

প্রতিবছর পৃথিবী থেকে এক শতাংশ বন উজাড় হচ্ছে। আর বাংলাদেশে প্রতি বছর ২ হাজার হেক্টর বনভূমি উজাড় হচ্ছে। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৪৫০টি থাকলেও এখন তা ১০০-এর কাছাকাছি নেমে এসেছে।

বাংলাদেশে জ্বালানির প্রয়োজনে গাছ কাটা হয়। পরিবেশ আইন-২০০০ এর বিধি অনুসারে প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণে আইনি বাধ্যতা থাকলেও বেদখল হয়ে যাচ্ছে নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড় প্রভৃতি জলাশয়। বাংলাদেশের ছোট বড় ২৩০টি নদীর মধ্যে ১৭৫টি মৃতপ্রায়। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮ ক অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’

বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হয়। যে হারে উষ্ণতা বাড়ছে তাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ডুবে যাবে। কমে যাবে কৃষি ভূমি-আবাদস্থল। খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাবে। তা বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব পড়বে। অনেক প্রজাতির প্রাণীরও বিলুপ্তি আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বন ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন হয় না। এতে নিজের পায়ে নিজেদেরই কুড়াল মারা হয়। উন্নয়নকে একমুখী করে এখন ভাবা যাবে না। উন্নয়নের আগে চিন্তা করতে হবে, সেটা দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন কিনা। বাংলাদেশে প্রতি বছর বন উজাড়ের হার তিন শতাংশ। এ অবস্থায় জীববৈচিত্র্য, বনভূমি, আদিবাসী, মানুষ, উন্নয়ন সবকিছু আমলে নিয়ে কিভাবে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের পথে এগুনো যায় তা নিয়ে ভাবা উচিত।

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র : গবেষক ও কলাম লেখক
bhushan.bibhutimitra@gmail.com


https://www.kholakagojbd.com/prints/36627

6/09/2024

গাছ কাটা কেন বন্ধ হয় না ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র




 গাছ কাটা কেন বন্ধ হয় না

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

০৬ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘গাছ কেটো না’ শিরোনামে একটি কবিতা আছে। এর প্রথম কয়েকটি লাইন এমন-

কাল যে ছিল গাছের সারি/ আজ পড়েছে কাটা, / রাস্তা দিয়ে তাই তো ভারী/ শক্ত হলো হাঁটা। / রোদ্দুরে গা যাচ্ছে পুড়ে/ এখন রাস্তাঘাটে/ বাইরে গেলেই ভরদুপুরে/ এখন চাঁদি ফাটে।

সনাতন ধর্মে তো বেশ কিছু গাছের সরাসরি পূজা করা হয়। যেমন - তুলসী, অশ্বত্থ, বেল, নিম, বট, আমলকী। তুলসীগাছকে এরা শুভ ও মঙ্গলসূচক মনে করে। এখানে তুলসীকে লক্ষ্মীর রূপ মনে করা হয়। অশ্বত্থগাছে ত্রিদেব দেবতা বাস করেন বলে এর রোপণ ও রক্ষা করলে ধনদৌলত, স্বর্গ ইত্যাদি লাভ হয় বলে মনে করা হয়। নিমগাছে নেতিবাচক শক্তির বিনাশ ঘটে বলে এটি বাসা বা অফিসে লাগিয়ে রাখা হয়। বটকে পবিত্র বৃক্ষ মনে করেন সনাতনীরা। এটি মানুষের দীর্ঘায়ু দান করে বলেও মনে করেন তারা।

বৃক্ষদেবতা আর নেই। সত্যি গাছ নেই। যে বৃক্ষের বুকে মুখ বুজে মানুষের জন্ম-মৃত্যু-বেঁচে থাকা, সেই বৃক্ষই এখন আর নেই। চারপাশে শুধু কংক্রিট। চারপাশে শুধু ইট-পাথরের দেয়াল। পত্রিকার পৃষ্ঠা ওল্টালেই প্রায় দেখা যায় গাছ কাটার মহোৎসব, অমুক জায়গায় কেটে ফেলা হলো গাছ, রাতের আঁধারে কাটা হলো গাছÑ এমন ধরনের খবর। এটা কোনো নির্দিষ্ট দিন বা মাসে নয়। এই খবর সারা বছরই চোখে পড়ে। কিন্তু কেন আমরা সহজেই কেটে ফেলছি গাছ। গাছ কেটে ফেলাটা এত সহজ কেন? এর কি কোনো আইন নেই? আসলেই বৃক্ষ হত্যার কোনো আইন নেই আমাদের দেশে। এগুলোই মূল কারণ। অবাধে গাছ কাটার অন্যতম কারণ গাছ কাটা নিয়ে নির্দিষ্ট আইন না থাকা। ফলত দোষী ব্যক্তিরা সাজা পাচ্ছেন না। এসব সুযোগে গাছ কাটায় উৎসাহিত হচ্ছেন। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ গাছ কাটা নিয়ে আদতে বাংলাদেশে তেমন কোনো মামলা নেই। যে মামলা আছে তা রিট মামলা। এ গাছ কাটা অপরাধ সংক্রান্ত মামলা চোখে পড়ে না। গাছের যেহেতু ব্যবহার আছে, মানুষ গাছ তো কাটবেই। কিন্তু এই কাটাটার মধ্যেও রয়েসয়ে কাটার একটা ব্যাপার আছে। কিছু রীতিনীতি আছে।

এ অঞ্চলে প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্রাবিড় সভ্যতার বিকাশের সময় বনের ব্যবহার সম্পর্কে জানা গেছে। সে সময় তারা গাছ কেটে ঘর বানাত। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। বেদ, পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারতেও বন ও বনায়ন সম্পর্কে জানা যায়। এসব গ্রন্থে শাল, বেল, কিংশুক প্রভৃতির কথা উল্লেখ আছে। সম্রাট অশোক সম্পর্কে জানা যায়, তিনি বন ও বন্যপ্রাণী ভালোবাসতেন ও সেসবের খুব যত্ন নিতেন এবং বন সংরক্ষণ করতেন। মোগলদের আমলে বন সংরক্ষণের কথা তেমন পাওয়া না গেলেও তাদের বন ব্যবহার করার কথা জানা গেছে। তারা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য বনের গাছ ব্যবহার করত। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যাপক মাত্রায় বন কেটে রেললাইনসহ নানা কাজ শুরু করলেও ভারতবর্ষে প্রথম বন সংরক্ষণের কথা আসে লর্ড ডালহৌসির আমলে। পরে ১৮৬৪ সালের ১ নভেম্বর প্রথম ভারতে বন বিভাগ চালু হয়।

যদিও অনেক জায়গায় গাছ কাটা নিয়ে বেশ কিছু আইন আছে। যেমন ইউপি ট্রি সংরক্ষণ আইন বলে একটি আইন আছে। এটি সংশোধিত হয় ২০১৭ সালে। এই আইন অনুযায়ী নিম, আম, মহুয়া, পিয়াল ইত্যাদি গাছ কাটার আগে অনুমতি নিতে হয়। এই আইনে এও বলা আছে, যদি একটি বড় গাছ কাটা হয় তবে একটি বড় গাছ কাটার জন্য ১০টি ছোট গাছ লাগাতে হবে। ১০টি ছোট গাছ লাগাতে যদি জমি কম পড়ে সে ক্ষেত্রে বাকি জমি বন বিভাগকে দিতে বলা হয়েছে। ১৯২৭ সালের ভারতীয় বন আইন অনুযায়ী প্রতিটি রাজ্যে গাছ কাটা বন্ধে বিধিনিষেধ রাখার কথা বলা হয়েছে। এখানেও গাছ কাটার জন্য অনুমতি এবং অনুমতি ছাড়া গাছ কাটলে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দানের কথা বলা আছে। ২০০৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ বন অচল সংরক্ষণ আইনেও গাছ কাটা বন্ধে বলা হয়েছে বন অঞ্চলে কোনো গাছ কাটা যাবে না। তবে আগাছা জাতীয় গাছ কেটে ফেলতে বা অপসারণ করতে পারবেন। এখানেও বেআইনিভাবে গাছ কাটলে ১ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ১৯৭১ সালে ভারতের মহারাষ্ট্রের গাছ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বেআইনি গাছ কাটার শাস্তি ১ হাজার থেকে ৫ হাজার এবং ১ সপ্তাহ থেকে ১ বছরের কারাদণ্ড।

বাংলাদেশেও বন আইন আছে। এখানে কিছু বিধিনিষেধ দেওয়া আছে। জীববৈচিত্র্য, প্রতিবেশ ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বৃক্ষ সংরক্ষণ বিল ২০১২ সংসদে উত্থাপন করা হয়। এতে বন ও সড়কের পাশে গাছ কাটলে সর্বোচ্চ ৩ মাসের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধার রাখা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বনের গাছ আহরণ বন্ধ রাখা হয়েছে ১৯৮৯ সাল থেকে। এই বিলে বলা আছে, সরকার গাছ কাটার অনুমতি দিলে প্রতি একটি গাছের বিপরীতে তিনটি গাছ লাগাতে হবে। এমনকি বন বা সরকারি স্থানের কোনো গাছ মরে গেলে বা শুকিয়ে গেলেও এটি কাটা যাবে না। বন্যপ্রাণী ও আবাসস্থল হিসেবে তা সংরক্ষণ করতে হবে।

একটি দেশের ২৫ ভাগ বন থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে আছে ৮ শতাংশের মতো। তাই এই মুহূর্তে বৃক্ষ কর্তনসংক্রান্ত যথাযথ আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র : শিক্ষক ও গবেষক


https://www.dainikamadershomoy.com/details/018fe99a90393

প্রয়োজন পরিকল্পিত সামাজিক বনায়ন ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 



প্রয়োজন পরিকল্পিত সামাজিক বনায়ন

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 আপডেট : ০১ জুন ২০২৪, ০৭:৪১ এএম|প্রিন্ট সংস্করণ



সারা বিশ্বেই বনের আশপাশের স্থানীয় জনগণ বনকে যেমন ব্যবহার করে, তেমনি রক্ষণাবেক্ষণও করে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় প্রায় ১৪০ মিলিয়ন মানুষ বনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। সামাজিক বনায়ন একটি বিকল্প বন ব্যবস্থাপনা। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ বনে বাস করে এবং একই সঙ্গে বনকে ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। এর মাধ্যমে তাদের অধিকার ও স্থানীয় জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য যেমন দূর করা হয়, তেমনি স্থানীয় অধিবাসীদের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন করা হয়। এটি খুব সহজেই কম খরচের মাধ্যমে করা যায়।

বাংলাদেশ বন ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দেশটিতে ২.১৬ মিলিয়ন বন রয়েছে, যা প্রায় ১৪ শতাংশ। অনেকের তথ্যমতে, অনেক জেলায় বনের তথ্য নেই। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালে বন হ্রাসের হার ছিল ২.১ শতাংশ, ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালে এটি কমে হয়েছে ০.২ শতাংশ। তারপরও বন হ্রাসের বৈশ্বিক হার (০.১ শতাংশ) থেকে বেশি। বন হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য, জ্বালানি কাঠের চাহিদা, কৃষিভূমির অপ্রতুলতা, শিল্পায়ন প্রভৃতি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালে সামাজিক বনায়নের কর্মসূচি নেওয়া হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি। একটি স্থানীয় জনগণকে বন সংরক্ষণে অংশগ্রহণ করানো। আরেকটি হলো দরিদ্র মানুষের আর্থসামাজিক জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো।

তবে এ চিত্রটি খুব একটা সুবিধাজনক নয়। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেনি। আবার বিভিন্ন সংগঠন প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থও হয়েছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে বন বলতে ম্যানগ্রোভ, পাহাড়ি ও শাল বন রয়েছে। ২৮ জেলায় কোনো জাতীয় বন নেই। সামাজিক বনায়নের কারণে এখন অবশ্য প্রায় সব জেলায়ই কিছু না কিছু বন রয়েছে। এর মধ্যে প্রাকৃতিক বন রয়েছে ৮৩ শতাংশ।

১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ আমল এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান আমলে বন থেকে কাঁচামাল শিল্পকারখানায় দেওয়া হতো। ১৯৭৯ সালে জাতীয় বন নীতিমালা করা হয়। পরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সামনে রেখে নীতিমালা সংশোধন করা হয়। কৃষি বনায়ন শুরু হয় আসলে ১৮৭৩ সালে। বন বিভাগ তখন পাহাড়ি এলাকায় টিক বনায়ন শুরু করে। প্রায় ১০০ বছর পর ১৯৬০ সালে বন বিভাগ সারা দেশে বন সম্প্রসারণ কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৮২ সালে বন বিভাগ অংশগ্রহণমূলক সামাজিক বনায়ন শুরু করে। এডিবির সহায়তায় উত্তরাঞ্চলে সাতটি জেলায় এটি শুরু করা হয়। বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ১৯৮৮ সালে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি শুরু করা হয়। অবশ্য সে সময় পাহাড়ি তিনটি এ প্রকল্পের আওতায় ছিল না।

সামাজিক বনায়নের উদ্দেশ্য ছিল কাঠ ও জ্বালানি কাঠের চাহিদা মেটানো, দরিদ্র জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, কর্মসৃজন, বন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বন বিভাগ ৪৪ হাজার ৪০৮ হেক্টর উডলট, ১০ হাজার ৬২৬ হেক্টর কৃষি বন, ৬১ হাজার ৭৩৯ হেক্টর স্ট্রিপ চাষ করেছে।

সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে কৃষি বনায়নের মাধ্যমে খুব সহজেই স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা যায়। এর মাধ্যমে ভূমি সংকোচন কমে। কৃষি বনায়নের ফলে বন সংকোচন বন্ধ হয়। এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণে নানা চাহিদা পূরণ করা যায়। এর মাধ্যমে স্থানীয়রা অর্থনৈতিক সুবিধা পায়। ভূমিহীন মানুষ, বিধবা নারী, বেকার যুবক ও অন্যান্য দরিদ্র মানুষকে কৃষি বনায়নের সঙ্গে যুক্ত করে বন ও জীবনমানের উন্নতি করা যায়। সামাজিক বনায়নে সম্পৃক্ত মানুষ এখন ৭৫ শতাংশ লভ্যাংশ পায়, আগে এটি ছিল ৪৫ শতাংশ।

কৃষি বনায়ন বাংলাদেশে জনপ্রিয় হলেও এখানে অনেক অব্যবস্থাপনা রয়েছে। যেমন, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় আগেভাগেই গাছ কেটে ফেলা হয়। বন বিভাগ কৃষি বন, উডলট বন, বাড়ির পাশে কৃষি বনায়ন, বৃক্ষরোপণ, স্ট্রিপ চাষ, বাঁশ চাষ, হোগলা চাষ, আগার চাষ, মৌ চাষ, রেশম চাষ প্রভৃতি কর্মসূচি শুরু করে। বন বিভাগ অংশগ্রহণমূলক বনায়ন, গ্রামীণ বনায়ন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে নার্সারি প্রতিষ্ঠা, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বনায়ন, জুম চাষের মাধ্যমে বনায়ন, সামাজিক বনায়নের প্রশিক্ষণ প্রভৃতি কাজ করে। বাংলাদেশে কৃষি বনায়ন দীর্ঘদিন ধরে চললেও এর বেশ কিছু বাধা রয়েছে। প্রথম বাধাটি ভূমিকেন্দ্রিক। এ ছাড়া এসব প্রকল্পের যথাযথ পর্যবেক্ষণ করা হয় না। উৎপাদিত বস্তুর বাজারজাতকরণ ঠিকমতো হয় না। প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাব। অপ্রতুল গবেষণা। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার অভাব। কৃষি বনায়নে তথ্যের ঘাটতি।

কৃষি বনায়নে উপযুক্ত গাছ হলো খেজুর, কাঁঠাল, তাল, আম, নারিকেল, সুপারি, লিচু, বাঁশ প্রভৃতি। কিন্তু এসব উপযুক্ত স্থানীয় জাতের গাছ না রেখে উডলট, ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি নানা রকমের গাছ রোপণ করা হয়। দেশি গাছ থাকলে সেখান থেকে ওষুধ তৈরি করা যাবে। পশুপাখি তাদের খাবার পাবে। বাস্তুসংস্থান ঠিক থাকবে। ভেষজ ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ওষুধ তৈরির কাঁচামাল খুঁজে পাবে সহজেই। এসব গাছ থাকলে পুষ্টি ঘাটতি যেমন পূরণ হবে, তেমনি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার কাজগুলোও করা যাবে। মাটি, বাতাস সর্বোপরি পরিবেশ সুরক্ষিত থাকবে। বাংলাদেশে আশির দশকে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, পাইন এসব বিদেশি গাছ প্রবেশ করে। সে সময় এসব গাছের চারা বিনামূল্যেও বিতরণ করা হতো। পরে অবশ্য ২০০৮ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এর চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। বন বিভাগও এর উৎপাদন বন্ধ করে।

এ দেশে ইউক্যালিপটাস জনপ্রিয় হওয়ার কারণ এটি দ্রুত বাড়ে। তেমন একটা যত্ন লাগে না। চারা রোপণ করলে ছাগল-গরু এসবের পাতা খায় না। চাষ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। এসব বিদেশি গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় জ্বালানিতে অবদান রাখলেও এর ফলে একটা পরিবেশের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে। এটি মাটি থেকে বেশি পরিমাণ পুষ্টি ও পানি শোষণ করায় এর আশপাশের স্থানীয় জাতের গাছ এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছে কোনো পাখি বাসা বাঁধে না। এর নিচে যেমন বিশ্রাম নেওয়া যায় না, তেমনি এর কাণ্ড পাতায় কোনো অণুজীবও জন্মায় না। কাজেই সামাজিক বনায়নের আওতায় কোন গাছগুলো রোপণ করতে হবে, এ নিয়ে আরও সতর্কতা জরুরি। কোন অঞ্চলে কী ধরনের গাছ রোপণে স্থানীয়রা আগ্রহী ও লাভবান হবে, তার প্রতি খেয়াল রেখে সামাজিক বনায়নের পরিকল্পনা করা জরুরি।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

https://www.kalbela.com/ajkerpatrika/joto-mot-toto-path/92846



 


ইকোপার্ক : লাভের চেয়ে কি ক্ষতিই বেশি ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র