11/22/2024

হাতি সংরক্ষণ প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 

হাতি সংরক্ষণ

প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

ড. বিভূতিভূষণ মিত্র

প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:১৭ এএম

ড. বিভূতিভূষণ মিত্র

বাংলাদেশে বসবাসরত হাতির নাম এশিয়ান এলিফ্যান্ট। এ হাতি খুব কম দেশেই দেখা যায়। বিশ্বের ১৩ দেশে এর বিচরণ। আইইউসিএনের মতে বাংলাদেশে তিন ধরনের হাতি রয়েছে। এগুলো হলো তাদের নিজস্ব আবাসস্থলে বসবাসরত হাতি, পরিব্রাজনকারী হাতি ও পোষ মানা হাতি। বন্য প্রাণীবিদদের মতে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এসব হাতির সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০। একটি তথ্যমতে বাংলাদেশে আবাসস্থলে বসবাসরত হাতির সংখ্যা ২৬৮, পরিব্রাজনকারী হাতি ৯৩ আর পোষ মানা হাতি ৯৬টি। ২০১৯ সালের একটি তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা ছিল সে সময় ২৬৩টি। সাম্প্রতিক এক গবেষণা জরিপমতে বাংলাদেশে বর্তমান হাতির সংখ্যা ২২৮ থেকে ৩২৭। মূলত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে হাতি দেখা যায় বেশি। মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্বটা বেশি দেখা যায় সেখানেই। তবে শেরপুর, জামালপুর ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গায়ও হাতি দেখা যায়। বন বিভাগের তথ্যমতে ২০০৪ সাল থেকে ১৭ বছরে ১১৮টি হাতি হত্যা করা হয়।

আইইউসিএনের ২০২১ সালের তথ্যমতে বাংলাদেশে গত ১৭ বছরে ৯০টি হাতি হত্যা করা হয়েছে। প্রতি বছর শ্রীলঙ্কায় ২০০ হাতি হত্যার কবলে পড়ে। ভারতে মানুষ-হাতি সংঘর্ষে মারা পড়ে বছরে ১০০ হাতি। কেনিয়ায়ও এ সংখ্যা বছরে ১২০-এর বেশি। বাংলাদেশ বন্য প্রাণী আইন অনুযায়ী হাতি হত্যাকারীকে দুই থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সর্বনিম্ন অর্থদণ্ড দেওয়া হয় ১ থেকে ১০ লাখ টাকা। আত্মরক্ষার্থে এ আইন প্রযোজ্য নয়। বিজ্ঞানীদের মতে বাংলাদেশে হাতি চলাচলে মোট ১২টি জায়গা আছে। হাতি চলাচলের এসব জায়গা দিনদিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। হাতির খাদ্যগ্রহণ, প্রজননের জন্য এসব জায়গা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাতি চলাচলের এসব জায়গা স্বাভাবিক করা যেমন দরকার, তেমন দরকার হাতির পছন্দের গাছ লাগানো। এতে হাতি আর বাসাবাড়ির দিকে আসবে না খাবার না পেয়ে।

 গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ”র খবর পড়তে ফলো করুন

তা ছাড়া যেসব মানুষ বনাঞ্চলে বসবাস করে তারা হতদরিদ্র হওয়ায় হাতির সঙ্গে তাদের এক প্রকার প্রতিযোগিতা হয়। এতে মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব মানুষকে ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় এনে জীবনযাত্রার মান বাড়ানো যেতে পারে। বন্য প্রাণী হাতির সঙ্গে মানুষের প্রতিযোগিতা হয় মূলত জমি, খাদ্য, পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে। হাতির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হাতির বিচরণ ক্ষেত্রগুলোয় মানুষ বসতবাড়ি বানাচ্ছে। হাতি বসবাসের এলাকায় গড়ে উঠছে নতুন নতুন গ্রাম। এ ছাড়া খামার, শহর, বড় রাস্তা, শিল্পকারখানাও গড়ে উঠছে। হাতির যাতায়াতের পথে মানুষ বেড়া দিচ্ছে। হাতিরা মূলত তৃণভোজী। এরা দিনে ১৫০ কিলোগ্রাম ঘাস ও ১৯০ লিটার পানি পান করে। এজন্যই তাদের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়াতে হয়। একটি বড় পুরুষ হাতির ওজন ৬ হাজার ৮০০ কিলোগ্রাম, যা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের থেকে শতগুণ ভারী।

ভারতে ১৯৯২ সালে ‘হস্তী প্রকল্প’ চালু করা হয়েছিল। এ প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ছিল হাতির সংখ্যা, আবাসস্থল ও স্থানান্তরের পথ রক্ষা করা। হাতির বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করার পাশাপাশি হাতি সংরক্ষণ ব্যবস্থপনা গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়া। এ ছাড়া স্থানীয় জনগণের মধ্যে হাতি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি করাও এর উদ্দেশ্য ছিল। যেসব হাতি বন্দি সেসব হাতি যেন উন্নত চিকিৎসা পায় তা-ও লক্ষ্য ছিল। দেশে সম্প্রতি হাতি সংরক্ষণ প্রকল্পবিষয়ক একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে হাতি সংরক্ষণের নানা উদ্যোগের কথা উঠে আসে। সম্প্রতি পরিবেশ উপদেষ্টা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আনেন। যেমন উপদেষ্টা হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থল উন্নয়নের কথা বলেন। এ ছাড়া নিরাপদ প্রজনন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, হাতির সংখ্যা নিরূপণ ও গবেষণা, মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারসহ জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট ও রংপুর বিভাগের যে কটি জেলায় হাতি দেখা যায়, সেসব জেলায় এসব কর্মসূচি নেওয়ার কথা জানান উপদেষ্টা। কিছু গাছ আছে যেগুলো হাতির খাদ্য হিসেবে উপযোগী, সেসব গাছ লাগানোর ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। এ ছাড়া জলাধার খনন, হাতি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম গঠন, বায়োফেন্সিং নির্মাণ এসব উদ্যোগের কথা বলেন তিনি। বাংলাদেশে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসন ও বন এলাকার হতদরিদ্র মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি। কৃষিজমির ক্ষতি হয়ে মানুষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এটি যেমন দেখতে হবে, তেমন সেখানকার মানুষও যেন হাতিকে শত্রু মনে না করে, হাতির চলাচল যেন বাধাগ্রস্ত না করে সেদিকেও সচেতনতা বাড়াতে হবে। হাতিকে হাতির বিচরণ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক চলাফেরা আর পর্যাপ্ত খাদ্য-পানি রাখা হলে হাতিকেও আর লোকালয়ে আসতে হবে না। এতে এ দ্বন্দ্ব অনেকটাই কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

হাতি মনিটরিংয়ের জন্য ড্রোন ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে হাতির দল কোথায় কখন যাচ্ছে তা জেনে সহজেই ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। লোকালয়ে হাতি এলে পটকাবাজি ও সাইরেনের মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে বনের ভেতর তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। হাতি যেসব কারণে লোকালয়ে চলে আসে বিশেষ করে খাবার জল, বনের ভেতরে সেজন্য অনেক ঘাস লাগানো ও ডোবা খনন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আরও একটি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। হাতির সম্ভাব্য লোকালয়ে প্রবেশের রাস্তায় এক ধরনের যন্ত্র স্থাপন করা যেতে পারে। এ যন্ত্রটি হাতিকে দেখামাত্র সাইরেন বাজাবে। এতে হাতিরা ভয়ে বনের ভেতরে ঢুকে যাবে। এ ছাড়া স্থানীয়দের সঙ্গে রেডিও নেটওয়ার্ক স্থাপন, বনকর্মীদের মোটরসাইকেলের মাধ্যমে স্মার্ট প্যাট্রলিং এসব উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

শিক্ষক ও গবেষক

হাতি সংরক্ষণ মতামত ড. বিভূতিভূষণ মিত্র


https://protidinerbangladesh.com/opinion/119019/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%9F%E0%A7%8B%E0%A6%9C%E0%A6%A8-%E0%A6%A6%E0%A7%80%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%98%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%BF-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%A8%E0%A6%BE

জলবায়ু অর্থায়নে ন্যায়বিচার ও সমতার দাবি ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 

কপ-২৯

জলবায়ু অর্থায়নে ন্যায়বিচার ও সমতার দাবি

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫১ এএম

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সম্মেলন অর্থাৎ কনফারেন্স অব পার্টিজের ২৯তম আসর বসেছে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। এই সম্মেলন ১১ নভেম্বর শুরু হয়েছে। শেষ হবে ২২ নভেম্বর। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এ সম্মেলনে অংশ নেয়। সদস্য সংখ্যা ১৯৮। ১৯৭ দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলে মোট ১৯৮। এ সম্মেলনে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, সরকারি কর্মকর্তারা ছাড়াও পরিবেশবিষয়ক বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, আদিবাসী প্রতিনিধি, গবেষণা প্রতিষ্ঠানও অংশ নিতে পারে। সারা বিশ্বের জলবায়ু, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে নীতিনির্ধারণী আলোচনা করা হয়। পরিবেশ ও জলবায়ুসংক্রান্ত নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রতি বছর এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান এলাকাগুলো থেকে কপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। পর্যায়ক্রমে সেসব দেশেই কপ হয়ে থাকে। কোনো কারণে কোনো দেশ অপারগ হলে তা জার্মানির বনে অনুষ্ঠিত হবে। কপের শুরু ১৯৯২ সালে রিওডি জেনেরিওতে। তবে তা ছিল মূলত আর্থ সামিট। এরপর ১৯৯৫ সালে বার্লিনে কপ হয়। এটিই আসলে কপের প্রথম সভা। এ সম্মেলনের মাধ্যমে কিয়োটো প্রটোকল, প্যারিস চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

প্যারিস চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ এ চুক্তিতে বলা হয়Ñ উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা করবে। এ সহায়তা ২০২০ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। কিন্তু এটা শুধু চুক্তিই ছিল। সাহায্য যা এসেছে তা একেবারেই অপ্রতুল। সাহায্য না এলেও তৃতীয় বিশ্ব উন্নত দেশ দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি লেগেই আছে। প্যারিস চুক্তিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো, এ বিশ্বের তাপমাত্রা এ শতাব্দীর মধ্যে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখা। এ ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন নিঃসরণ ৫০ ভাগে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে তাপমাত্রা কিন্তু বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই। উন্নত দেশগুলোয় যে হারে শিল্পবিপ্লব হয়েছে, একই হারে তারা পরিবেশদূষণ ঘটিয়েছে। এর কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ২১০০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১.৬২ সেন্টিমিটার বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া কার্বন নিঃসরণের কারণে বন্যা-খরা-প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। গত এক শতকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিজ্ঞানীদের মতে, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে ১ মিটার। এতে ৪৩টি দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে হারিয়ে যেতে পারে।

 গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ”র খবর পড়তে ফলো করুন

বাংলাদেশ বিশ্বের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমাদের অধিকাংশ অঞ্চল বন্যাপ্রবণ। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকা প্রতি বছর বন্যার কবলে পড়ে। এ ছাড়া নদীভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল। বাংলাদেশের মোট ১৮ ভাগ জমি বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ফলে নিম্নভূমি প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এতে কৃষি, নানান অবকাঠামো ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। অন্যদিকে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল খরাপ্রবণ হওয়ায় পানিসংকটের সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশে মূলত তিন ধরনের বন্যা দেখা যায়। এগুলো হলো মৌসুমি বন্যা, আকস্মিক বন্যা ও জোয়ারে সৃষ্ট বন্যা। মৌসুমি বন্যা হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ে। এতে একটি এলাকা প্লাবিত হয়। ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করে। আকস্মিক বন্যা হয় পাহাড়ি ঢল বা হঠাৎ অনবরত বৃষ্টি থেকে। আর জোয়ারের সময়ে যে বন্যা হয় তাকে জোয়ারের ফলে সৃষ্ট বন্যা বলে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়। অর্থাৎ ১৮ শতাংশ এলাকা বন্যার কবলে পড়ে। বন্যা ব্যাপকভাবে হলে ৫৫ শতাংশ ডুবে যায়। বাংলা অঞ্চলে প্রতি শতাব্দীতেই অর্ধডজন বন্যা দেখা গেছে। এগুলো ভয়াবহ বন্যা হিসেবেই স্বীকৃত।

বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেকবারই বন্যার দেখা মিলেছে। এমনকি রামায়ণ-মহাভারতেও এ অঞ্চলের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম বন্যা দেখা যায় ময়মনসিংহে ১৯৭৪ সালে। সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা দেখা যায় ১৯৮৮ সালে। এর আগে ১৯৮৭ সালের বন্যায়ও কম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। স্বাধীনতার আগে এ অঞ্চলে ১৭৮১, ১৭৮৬, ১৭৯৪, ১৮২২, ১৮২৫, ১৮৩৮, ১৮৫৩, ১৮৬৪, ১৮৬৫, ১৮৬৭, ১৮৭১, ১৮৭৬, ১৮৭৯, ১৮৮৫, ১৮৯০, ১৯০০, ১৯০২, ১৯০৪, ১৯১৫, ১৯৫৫, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৬৯ সালে স্মরণ করার মতো বন্যা হয়েছে। সম্প্রতি গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দি এনভায়রনমেন্ট এবং সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিকসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যায় ৫৫-৬০ শতাংশ জলমগ্ন হয়। এতে ১ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের ক্ষতি হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে এও বলা হয় দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ বন্যার উচ্চঝুঁকিতে আছে। এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে বলা হয়েছে এবং এ থেকে ভয়াবহ বিপর্যয়ও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।

জলবায়ু অর্থায়নে ন্যায়বিচার ও সমতার জন্য বিপদের মুখে রয়েছে স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি)। মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে। এজন্য বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নের কাঠামোয় আমূল পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা। আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত সিআই ও নাকমের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত সাইড ইভেন্টে এ দাবি জানানো হয়। চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের (সিআই) জলবায়ু ঋণঝুঁকি সূচক ২০২৪ (সিডিআরআই) শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অনুদানভিত্তিক অর্থায়ন, শতভাগ ঋণমুক্তি এবং প্রকৃতিভিত্তিক অর্থনীতিই এ সংকট উত্তরণের মূল চাবিকাঠি। বাংলাদেশ ও মালাউই, যারা ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ তালিকায় রয়েছে, ক্রমবর্ধমান সিডিআরআই স্কোরের সম্মুখীন হচ্ছে, যা আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে। বিশেষত বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জলবায়ু ঋণের বোঝা ৭৯.৬১ মার্কিন ডলার, যা দেশের পরিবেশগত দুর্বলতার সঙ্গে অর্থনৈতিক ঝুঁকির অসামঞ্জস্যতা নির্দেশ করে। দেশের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই) স্কোর ২৮.৩৩, যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট চ্যালঞ্জেরে প্রতি উচ্চ সংবেদনশীলতার প্রতিফলন।

অন্যদিকে ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নাকম) গত দুই দশকে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সর্ম্পকিত অভিজ্ঞতার আলোকে তথ্য তুলে ধরেছে। সিডিআরআইয়ের যে জলবায়ু অর্থায়নের বড় একটি অংশ প্রশমন (মিটিগেশন) কার্যক্রমে কেন্দ্রীভূত, যেখানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়গুলোর জন্য অত্যাবশ্যক অভিযোজন প্রচেষ্টা উপেক্ষিত হয়েছে। এ বৈষম্য দূর করতে এবং এলডিসিগিলোর ভভিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে কাবন ট্যাক্স, সম্পদকর এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকি সংস্কারসহ শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড সংক্ষেপে জিসিএফ ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। অথচ তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ১০০ বিলিয়ন ডলারের। ২০২০ সালে শুরু করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রয়োজন ২০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ ২০১৪ সাল পর্যন্ত পেয়েছে মাত্র ৭১০ মিলিয়ন ডলার। এবার বাংলাদেশ এ তহবিল ১ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার দাবি করছে। কপ-২৮-এ বাংলাদেশ জলবায়ু অর্থায়নের পক্ষে কথা বলে। এতে অনেকটা সফলতা আসে। এবারের কপ-২৯-এ যেসব বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে সেগুলো হলো কার্বন নিঃসরণ কমানো, জীবাশ্ম জ্বালানি তেল-গ্যাস-কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা, জলবায়ুর ওপর শিল্পের প্রভাব কমাতে পারে এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, পুনরুৎপাদনযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ প্রভৃতি।

বাংলাদেশ এবার জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে কথা বলবে। অর্থাৎ উন্নত দেশগুলো অর্থায়ন করলে উন্নয়নশীল দেশ সবুজ জ্বালানি ব্যবহারে বিনিয়োগ যেমন করতে পারবে তেমন অভিযোজিতও হতে পারবে। এ ছাড়া ন্যায্য স্থানান্তর, জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি নিয়ে আলোচনা করবে। বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপের মতো দেশগুলো উন্নত দেশের কাছ থেকে এসব ন্যায্য জলবায়ু তহবিল সহায়তা পাবে, এটাই এখন সবার প্রত্যাশা।

শিক্ষক ও গবেষক


https://protidinerbangladesh.com/opinion/120012/%E0%A6%9C%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%81-%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%93-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%BF

পলিথিনের পর্যাপ্ত বিকল্প ব্যবস্থা থাকা দরকার ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র



পলিথিনের পর্যাপ্ত বিকল্প ব্যবস্থা থাকা দরকার

 ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

পলিথিনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি অনেক। চোখ জ্বালা করা, শ্বাসকষ্ট, লিভারের সমস্যা, ক্যান্সার, চর্মরোগ থেকে শুরু করে অনেক মারাত্মক রোগের জন্য পলিথিন দায়ী। আমরা বাজারে গেলে পলিথিনে করেই সব কিছু নিয়ে আসি। এমনকি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যও।

  অথচ পলিথিনে মোড়ানো এসব খাবারই খাদ্যে বিষক্রিয়ার জন্য দায়ী। মাছ-মাংস পলিথিন ছাড়া আমরা রাখি না। কিন্তু পলিথিনে মাছ-মাংস প্যাকিং করলে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। প্লাস্টিকের বর্জ্য মাইক্রো ও ন্যানো কণা রূপে মানুষের শরীরে ঢুকে হরমোনজনিত নানা সমস্যা সৃষ্টি করছে।

এটি মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুক্রাণু ও ডিম্বাণু উৎপাদন ব্যাহত করছে। ক্যান্সারসহ ত্বকের নানা রকম রোগ সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ কলের পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে, যেখান থেকে প্রতি মাসে ২১ গ্রাম এবং বছরে ২৫০ গ্রাম এই প্লাস্টিক মানুষের শরীরে ঢুকে গুরুতর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফথেলেটস, বিসফেনোন, অর্গানোটিনস, পার ও পরি ফ্লোরোঅ্যালকাইল, বিসফেনল এ প্রভৃতি রাসায়নিক উপাদান প্লাস্টিকে থাকে, যা স্থূলতা, গর্ভধারণের ক্ষমতা হ্রাস, বিভিন্ন স্নায়ুরোগ ঘটাতে পারে। প্লাস্টিক জনস্বাস্থ্যের জন্যই হুমকি নয় শুধু। এটি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করছে। পলিথিনে, বিশেষ করে রঙিন পলিথিনে থাকে সিসা ও ক্যাডমিয়াম, যা চর্মরোগের জন্য দায়ী। অথচ এই পলিথিন ছাড়া আমরা যেন অচল।

ঢাকা শহরে একেকটি পরিবার দিনে চারটি করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। শুধু ঢাকায়ই এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয় প্রতিদিন।

বিশ্বে প্রতিবছর প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয় প্রায় ৪৫ কোটি টন। প্লাস্টিক বর্জ্য ৪০০ বছর পর্যন্ত পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব রাখতে পারে। প্লাস্টিক দূষণকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। প্লাস্টিক এখন সাগরের তলদেশ থেকে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি হয় প্রায় পাঁচ লাখ। বিশ্বে বছরে ৮০ লাখ টন বর্জ্য সাগরে মেশে। একটি গবেষণার তথ্য মতে, দোকানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ২০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। কোমল পানীয়তে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর বোতল হিসেবে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ৪৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে।

বাংলাদেশে প্রতিদিন তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, ঢাকায় প্রতিদিন ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। ঢাকার মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের ৩৭.২ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের ৬০ শতাংশ মেশে রাস্তাঘাট আর নদীতে। মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, আমাদের দেশে প্রতিবছর আট লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য হয়। এর মাত্র ৪০ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ দুই লাখ ২৮ হাজার টন পুনরায় ব্যবহৃত হয় আর বাকি অংশ পরিবেশেই থেকে যায়।

বাংলাদেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির বাজার এক বিলিয়ন ডলারের। প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। ঢাকায় প্রতিদিন এক কোটি ২০ লাখ পলিব্যাগের বর্জ্য ফেলা হয়। প্লাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছেই। বাংলাদেশে ২০০৫ সালে এর বার্ষিক মাথাপিছু ব্যবহার ছিল তিন কেজি। এটি বেড়ে ২০২০ সালে হয়েছে ৯ কেজি। অর্থাৎ ১৫ বছরে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে তিন গুণ। সরকারের এসব প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের আলাদা কৌশল রাখতে হবে। যেমন শুধু প্লাস্টিকের জন্য আলাদা কনটেইনার রাখা যেতে পারে। রিসাইক্লিং করার পরিকল্পনা থাকতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন কম্পানি, যারা প্লাস্টিকে পণ্য বিক্রি করে, তাদের এসব প্লাস্টিক ব্যবহার করে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলার পরিকল্পনা থাকা জরুরি।

বাংলাদেশই বিশ্বে প্রথম প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ২০০২ সালে। ২০১০ সালে প্লাস্টিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ন্যাশনাল থ্রিআর (3R)  নীতি চালু করে। ন্যাশনাল থ্রিআর অর্থ হলো রিডিউস, রিইউজ ও রিসাইকল। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার জুট প্যাকেজিং আইন পাস করে। 

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার ১ অক্টোবর থেকে সুপারমার্কেট এবং ১ নভেম্বর থেকে সব কাঁচাবাজারে পলিথিন ও পলিপ্রপিলিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। এটি ভালো কাজ। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে বাজারে যেন এসব ব্যাগের বিকল্প থাকে। সরকার বলছে, এর বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগের সরবরাহ থাকবে। শুধু নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেই কাজ হবে না। পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেই এটি সফল হবে। দোকানি বা ব্যবহারকারীদেরই এ ক্ষেত্রে নজরে আনলে চলবে না। পলিথিন উৎপাদনকারীদের ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে। 

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক


https://www.kalerkantho.com/online/miscellaneous/2024/10/03/1431352

ইটভাটায় প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি

 ইটভাটায় প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি


জনস্বাস্থ্য

ইটভাটায় প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি

আইন অনুসারে ইটভাটা যে জেলায় অবস্থিত, সেখানকার জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া ছাড়া কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করতে পারবে না এবং ইটভাটা ছাড়া কোথাও ইট প্রস্তুত করা যাবে না। আইনে মাটি ব্যবহার সংক্রান্ত কথাও বলা আছে। এতে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি ইট তৈরি করার জন্য কৃষিজমি, পাহাড় বা টিলা থেকে মাটি কেটে ইট তৈরি করতে পারবে না। তবে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে মজা পুকুর, খাল-বিল, দিঘি, নদনদী, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল বা পতিত জায়গা থেকে মাটি কেটে তা ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। এই আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর জন্য জ্বালানি হিসেবে কোনো জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করতে পারবে না। ৮ ধারায় বলা হয়েছে, ছাড়পত্র থাকুক বা না থাকুক; আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর, সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি, কৃষিজমি, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় সীমানার ভেতরে কোনো ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না।     

এসব বিধি লঙ্ঘন করলে শাস্তিরও বিধান রাখা হয়েছে। ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যক্তি ইটভাটা স্থাপন করলে, পরিচালনা বা চালু রাখলে ১ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এ ছাড়া ১৫ ধারামতে, ইট তৈরি করার জন্য কৃষিজমি, পাহাড় বা টিলা থেকে মাটি কেটে সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করলে বা জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া ইট তৈরির জন্য মজা পুকুর, খাল-বিল, দিঘি, নদী, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল, পতিত জায়গা থেকে মাটি কাটলে অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এ ছাড়া ইটভাটায় জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করলে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।     

২০২৩ সালে এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা ৭৪ মাইক্রোগ্রাম। ভারতে ৫৮.৭ মাইক্রোগ্রাম ও চীনে ৩০.২ মাইক্রোগ্রাম একই সময়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর কমপক্ষে ৬.৮ বছর আয়ু কমে যাচ্ছে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের তথ্যমতে, বিশ্বে দূষণের তালিকায় শীর্ষে এখন ঢাকা। শহরটির এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর এখন ২৮০; সংস্থা অনুযায়ী। পাকিস্তানের লাহোরের স্কোর ২৩৪, ভারতের দিল্লির ২২৪ এবং কলকাতার ১৯০।
ক্লিন এয়ার ফান্ডের একটি তথ্যমতে, স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটি ফান্ডিং ২০২৩-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বায়ুর গুণগত মান উন্নয়নের তহবিলপ্রাপ্তিতে তৃতীয় ছিল বাংলাদেশ।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি কারণ হলো ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণকাজে সৃষ্ট ধোঁয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি তথ্যমতে, প্রতিবছর বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে আনুমানিক ৩০ লাখ মানুষ মারা যায়। স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগ, শ্বাসযন্ত্রের নানাবিধ সংক্রমণ হতে পারে এসব বায়ুদূষণের কারণে। এমনকি ঢাকার নিকটবর্তী গাজীপুরও দেশের সবচেয়ে দূষিত জেলা। এখানকার মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে ৮.৩ বছর। 

সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে পরিবেশ উপদেষ্টা নতুন করে ইটভাটার ছাড়পত্র দেওয়া হবে না বলে জানান। এ ছাড়া ৩ হাজার ৪৯১টি ইটভাটার ছাড়পত্র নেই বলে জানান। এসব ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হবে বলেও জানান। পার্বত্য এলাকায় যেসব ইটভাটা রয়েছে, সেসবও স্থানান্তর করা হবে। এসব ভালো উদ্যোগ। বাংলাদেশ ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের আগ্রহও ভালো ছিল। তারা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইট তৈরির বিষয়ে গুরুত্ব দেন। 
ইটের বিকল্প হিসেবে অপোড়ানো ব্লক ব্যবহারের ব্যাপারে সরকার এগিয়ে আসতে পারে। এই ব্লক ব্যবহার একটি ভালো পরিকল্পনা। এ নিয়ে সরকার আরও ভালো উদ্যোগ নিতে পারে। একই সঙ্গে ছাড়পত্রবিহীন ইটভাটা বন্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে পারে সরকার। 

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র: শিক্ষক ও গবেষক


https://samakal.com/opinion/article/260339/%E0%A6%87%E0%A6%9F%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%9F%E0%A7%8B%E0%A6%9C%E0%A6%A8-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%AC-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AF%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF



কতটা উন্নত সুন্দরবনের পরিবেশ ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 


কতটা উন্নত সুন্দরবনের পরিবেশ

 ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

খুব বেশিদিন আগে নয়, ২০২৩ সাল অর্থাৎ গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশের বাঘ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বাঘ পাচারে বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষ দেশ। বাঘ নিয়ে গবেষণা করে প্যানথেরা নামের একটি সংগঠন এবং চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেস এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্দরবনে শিকার হওয়া বাঘের বিভিন্ন অংশ বিশ্বের ১৫টি দেশে পাচার করা হয়, যদিও সরকার দাবি করে আসছে যে বাঘ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তারা যথাযথ ব্যবস্থা রেখেছে।

যা হোক, এই প্রতিবেদনটি যে কাউকে চমকে দেওয়ার মতো।

বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবনের বাঘ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে ২০১৬ সালে। শোনা যায়, অভিযান শুরুর পর অন্তত ১১৭ জন পাচারকারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কয়েক শ জন গ্রেপ্তার হয়েছে।

অনেকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় এসেছে। অভিযানের আগে পাচারকারীদের এই ব্যবসা ছিল রমরমা। গবেষণায় বলা হয়, আন্তর্জাতিক চক্র ছাড়াও দেশের ভেতরেও বাঘের বিভিন্ন অংশের চাহিদা আছে বলে উল্লেখ করা হয়, যদিও বন বিভাগ বলেছে গবেষণার এই বিষয়টি বিতর্কিত। গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের সুন্দরবন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর মায়ানমার অঞ্চলে বাঘ শিকার ও চোরাচালান হয়।

কনজারভেশন সায়েন্স ও প্র্যাকটিস জার্নালে এই প্রতিবদেনটি প্রকাশিত হয়। এতে বাংলাদেশের বাইরে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কোথায় কোথায় যায়, তা-ও চিহ্নিত করা হয়েছে। বাঘের এসব অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গের চাহিদা রয়েছে ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো দেশে। ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের চ্যানেলগুলো নিয়ন্ত্রণ করত প্রায় ৩০টি জলদস্যু দল। তাদের মধ্যে সাতটি জলদস্যু দল প্রত্যক্ষভাবে বাঘ শিকার করে এবং বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চোরাচালানে নেতৃত্ব দেয়।

গবেষকদলটি স্থল, সমুদ্র এবং আকাশপথে বাঘ পাচারের সঙ্গে জড়িত ১৬৩ জন চোরাকারবারি ও ব্যবসায়ীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এতে তারা বাঘ শিকারের চারটি উৎসস্থল চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো—ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন, ভারতের কাজিরাঙ্গা-গরমপানি পার্ক, মায়ানমারের নর্দার্ন ফরেস্ট কমপ্লেক্স ও ভারতের নামদাফা-রয়াল মানস পার্ক। 

একটি তথ্য মতে, সুন্দরবনে প্রথম বাঘ জরিপ হয় ২০১৩-১৪ সালে। সে সময় বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬। এক দশকে বাঘ কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ। ২০০৪ সালে ছিল ৪৪০টি। তবে এই সংখ্যাটি বাংলাদেশ ও ভারত দুই অংশের সুন্দরবন মিলিয়ে। ২০১৮ সালে বাঘশুমারিতে পাওয়া গিয়েছিল ১১৪টি। একটি তথ্য মতে, ২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে কমপক্ষে ৪৬টি বাঘ মারা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাঘের বিচরণক্ষেত্র ও বাংলাদেশে সুন্দরবনের মোট এলাকার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০ থেকে ২৫০টি বাঘ থাকা দরকার। একসময় বেশির ভাগ দেশে বাঘ পাওয়া যেত। এখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের মোট ১৩টি দেশে একে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গত ১০০ বছরে বাঘের সংখ্যা ৯৫ শতাংশ কমলেও এর সংখ্যা এখন বাড়ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে বাঘ জরিপের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৯.৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাঘের সংখ্যা হয়েছে এখন ১২৫। বাংলাদেশে বাঘের অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় হুমকি চোরা শিকার। চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্যও অনেকটা থামানো গেছে। সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করলে শিকার একেবারেই কমে যাবে। এ ছাড়া পাচার ঠেকাতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। ফাঁদ পেতে, বিষটোপ দিয়ে বাঘ শিকার করা হয়। এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, কোস্ট গার্ড ও বন বিভাগের সমন্বয়ে দক্ষ টিম থাকতে পারে সুন্দরবনে। বাঘ শিকারি বা হত্যাকারীর শাস্তি সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ সাত বছর এবং জরিমানা এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা। দোষীদের শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। জাতিসংঘের মতেও সুন্দরবনে বাঘ কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ চোরাকারবারি। সে ক্ষেত্রে সুন্দরবনের পরিবেশ সংরক্ষণের পাশাপাশি চোরাকারবারিদের ঠেকাতে পারলে বাঘের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে অনেকেই মনে করেন।  

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক


https://www.kalerkantho.com/online/miscellaneous/2024/10/20/1437100


সিসাদূষণ মোকাবিলা ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

https://www.ajkerpatrika.com/op-ed/column/ajpk5xshe0nov 


সিসা একটি নরম ধাতু। এটি ঈষৎ নীলাভ ধূসর বর্ণের। এর পারমাণবিক সংখ্যা ৮২। ধাতুটি এতটাই নরম যে একটি ছুরির সাহায্যে একে কাটা যায়। সিসা কিন্তু মারাত্মক ক্ষতিকর বিষ। এই বিষের ভেতরেই বাস করছে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ। বাংলাদেশের বাতাসে যেমন সিসার উপস্থিতি দেখা গেছে, তেমনি মাটিতে-পানিতেও পাওয়া গেছে। এমনকি খাবারেও সিসার উপস্থিতি দেখা গেছে।

সম্প্রতি ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) একটি গবেষণায় দেখা গেছে খোলা, প্যাকেটজাত দুধ এবং দইয়ে সিসা, ক্রোমিয়ামসহ অন্যান্য উপাদানের উপস্থিতি। সিসা নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। খাদ্যদ্রব্য ছাড়াও ধূমপান, পানীয় জল, নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদির মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করছে। এ ছাড়া পেট্রল, পেইন্ট, ব্যাটারি, খেলনা ইত্যাদির দ্বারাও সিসা ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানে বছরে দুই লাখ টন সিসা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এটি উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনচক্রকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। মাটিতে মিশছে। তারপর উদ্ভিদের শরীরে যাচ্ছে। এরপর প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করছে। এভাবে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে মানুষের শরীরেও।

বাতাসের সিসা মানুষের দেহে প্রবেশ করলে ক্যানসারসহ নানা রোগের সৃষ্টি করতে পারে, যার পরিণতিতে ঘটতে পারে মৃত্যুও। এ ছাড়া খাবারের মাধ্যমে শরীরের ভেতর সিসা প্রবেশ করলে বিভিন্ন অঙ্গ স্থায়ী বা সাময়িকভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যেমন কিডনি বিকল হতে পারে। সিসা সরাসরি দেহের কোষকে ক্ষতি করে। এরপর অস্থিমজ্জা, লিভার ও কিডনিকেও আক্রান্ত করে। রোগী রক্তশূন্যতায় ভোগে। বন্ধ হয়ে যায় শ্বেতকণিকা উৎপাদন। শ্বেতকণিকা আমাদের দেহে রোগপ্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে। এর সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও কমে যায়। ফলে নানা রকম রোগের সংক্রমণ ঘটতে থাকে।

এ ছাড়া সিসা আচরণগত সমস্যাও সৃষ্টি করে। শরীরে একবার সিসা প্রবেশ করলে রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে বাহিত হতে থাকে। অল্প অল্প করে সিসা শরীরে জমা হতে থাকে। এটি প্রথমে হাড়ে জমা হয়। সব বয়সী মানুষের ওপরই এটি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তবে শিশুদের শরীরে এর প্রভাব অনেক বেশি। শিশুরা যখন হামাগুড়ি দিয়ে খেলে বা খেলনা ও অন্যান্য জিনিসে মুখ রাখে, তখন সিসা শরীরে প্রবেশ করে। তবে সমস্যা যেটা হলো, এর বিষক্রিয়া শিগগির বোঝা যায় না। এটি ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করে। যদি শরীরে সিসার বিষক্রিয়া আছে শনাক্ত করা না যায়, তবে পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্কের ক্ষতি ও মারাত্মক মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে। এ ছাড়া বয়স্কদের প্রজনন সমস্যা, হজমের সমস্যা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, পেশির সমস্যা দেখা দিতে পারে। সিসাঘটিত বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মানুষকে অসুস্থ দেখায় না বলে রোগটা অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। এ জন্য রক্তে সিসার উপস্থিতি পরীক্ষা করা দরকার।

সিসার নানা রকম উৎস রয়েছে। বাতাস, মাটি, পানি ছাড়াও এটি নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। ভবন, সেতু, সুড়ঙ্গ নির্মাণ বা ভাঙার কাজ, ওয়েল্ডিং করা, ব্যাটারি, বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র ভাঙা, গাড়ি-নৌকা মেরামত করা, সিসা আছে এমন রঞ্জক বা গ্লেজ ব্যবহার করা, দাগযুক্ত কাচ, মাটির পাত্র বা গয়না নিয়ে কাজ—এ রকম নানা উৎস থেকে সিসা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন ব্যাটারি তৈরির কারখানায় সিসা ব্যবহৃত হয়। লেড পেইন্ট দিয়ে বাড়ি রং করা হলে সেসব সিসা বাতাসে মিশে পরিবেশের ক্ষতি করে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে লেড এভিয়েশন গ্যাস ব্যবহার হয়। এসব শিশুর রক্তের সঙ্গে মিশে সিসার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

সিসা থেকে বাঁচতে আমাদের নিজেদের কিছু করণীয় আছে। যেসব শিল্পকারখানায় সিসা ব্যবহার করা হয়, সেসব কারখানায় কাজ করলে ঘরে যাওয়ার আগে গোসল করে প্রবেশ করতে হবে। এ ছাড়া ঘর পরিষ্কার ও ধুলামুক্ত রাখতে হবে। জুতা খুলে ঘরে প্রবেশ করতে হবে। শিশুরা যেখানে খেলাধুলা করে, সেখানে ময়লা পড়ে থাকা জায়গাগুলো ঢেকে রাখা যেতে পারে।

সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সিসাদূষণ মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারা গবেষণার পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যাপারে কাজ করতে যাচ্ছে। এ নিয়ে তারা একটি বৈঠকও করে। এতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেমন সিসাদূষণ মোকাবিলায় আইন তৈরি ও নীতিমালা প্রণয়ন করা, দূষণের উৎসগুলোকে পরিবেশ ছাড়পত্রের আওতায় নিয়ে আসা, দূষণের উৎসগুলোকে চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা ইত্যাদি। যেহেতু সিসার বিষক্রিয়া সহজে ধরা পড়ে না, রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হয়, সেহেতু সিসাদূষণের উৎস চিহ্নিত করে তা জনসচেতনতার মাধ্যমে মোকাবিলা করাকে আমাদের প্রাধান্য দিতে হবে।

লেখক: ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র , শিক্ষক ও গবেষক

ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জরুরি

 

ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জরুরি

অন্যদৃষ্টি

ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জরুরি



বিভূতি ভূষণ মিত্র

 প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪ | ০০:০৬

ই-বর্জ্য বলতে ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক সামগ্রীকে বোঝায়, যার অর্থনৈতিক উপযোগিতা নেই। ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য বা যন্ত্রপাতিগুলোকে পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। যেমন– ঘরোয়া যন্ত্রপাতি; বিভিন্ন ধরনের ল্যাম্প, কাপড় ধোয়ার যন্ত্র, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, হিটার, ক্লিনার, টোস্টার, ব্যাটারি, টেলিভিশন, রেডিও, ডিভিডি প্লেয়ার, ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা ইত্যাদি। ধোঁয়া নির্ণয়কারী যন্ত্র, তাপ নিয়ন্ত্রক, থার্মোস্ট্যাট, ধোঁয়া নির্বাপক ইত্যাদি নিয়ন্ত্রক যন্ত্রপাতি। মাইক্রোস্কোপ, এমআরআই যন্ত্র, এন্ডোস্কোপি যন্ত্র, এক্স-রে মেশিন, আলট্রাসাউন্ড প্রভৃতি চিকিৎসা যন্ত্রপাতি এবং ল্যাপটপ, স্ক্যানার, ক্যালকুলেটর, নোটবুক, প্রিন্টার, মনিটর, ফ্যাক্স প্রভৃতিকে তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ধরা হয়।   

ই-বর্জ্যের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে। এক পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে বছরে ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১৮ সালে ই-বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে ১০ লাখ টন বর্জ্য তৈরি হয়। প্রতিবছর ই-বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে ৩০ শতাংশ করে। এই চিত্র শুধু বাংলাদেশ নয়; সারা বিশ্বেই ই-বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ইওয়েস্ট মনিটরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্বে ই-বর্জ্যের পরিমাণ ৬২ মিলিয়ন টন। এসব বর্জ্যের রিসাইক্লিং তেমন একটা হয় না বাংলাদেশে। প্রতিবছর দেশে মাত্র ১৩ হাজার ৩০০ টন ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং হয়। 
ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর ঝুঁকিও অনেক। ২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৫ শতাংশের বেশি শিশু মারা যায় ই-বর্জ্যের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ই-বর্জ্যের কারণে ফুসফুস ও স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এখন সিআরটি মনিটরের পরিবর্তে এলইডি মনিটর প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এসবে সিসা, ক্যাডমিয়াম, বেরিয়াম, ফ্লুরোসেন্ট পাউডার থাকে; যা মাটি-জল-বাতাসকে দূষিত করে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। চীনের গুইউকে বলা হয় ই-বর্জ্যের রাজধানী। কেননা, এখানে বিশ্বের ৭০ শতাংশ ই-বর্জ্য এই শহরের ওপর দিয়ে যেত। এ শহরে দুটি ভয়াবহ ঘটনা দেখা গেছে। এক. এখানকার মহিলাদের ৬ গুণ বেশি গর্ভপাত হয়েছে। দুই. এখানকার ৭০ ভাগ শিশুর দেহে অস্বাভাবিক মাত্রার সিসা পাওয়া গেছে।  

বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১ নামে একটি বিধিমালা রয়েছে। এই বিধিমালায় প্রস্তুতকারক বা সংযোজনকারীর দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে। ই-বর্জ্য মজুতকরণ পদ্ধতি সম্পর্কেও বিধিমালায় বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, সংগ্রহ কেন্দ্র, চূর্ণকারী, মেরামতকারী এবং পুনর্ব্যবহার উপযোগীকরণকারী ই-বর্জ্য ১৮০ দিনের বেশি সময় মজুত করতে পারবে না। আবেদনকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তবে তা ৯০ দিন পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে কিনা, ই-বর্জ্য মাটি-পানি-বাতাসের সঙ্গে সহজেই মিশে যায় কিনা, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।  

বেশ কিছু দিন আগে বাংলাদেশে পালিত হলো ই-বর্জ্য দিবস। দিবসটি উপলক্ষে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় রিসাইক্লিং শিল্পই হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান। এছাড়া তিনি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা কার্যকর করার কথা যেমন বলেন, তেমনি ইলেকট্রনিক পণ্য অল্প সময় ব্যবহার করেই বাতিল না করার পরামর্শ দেন। সত্যিকার অর্থে তাই যে রিসাইক্লিংই অর্থাৎ ই বর্জ্য পুনর্ব্যবহারই এর উৎকৃষ্ট সমাধান। এই ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে পারেন। ই-বর্জ্য থেকেও মূল্যবান সামগ্রী পুনরুদ্ধার করা যায়। এসব বিদেশে রপ্তানি করা যায়। এছাড়া মেমোরি কার্ড ও মাদারবোর্ডের মতো ই-বর্জ্য থেকে সোনা, রুপা, তামা, টিন পুনরুদ্ধার করা যায়। এসব এখন গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। এ ব্যাপারেও মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতে পারে। যারা রিসাইক্লিংয়ের পাশাপাশি হয়ে উঠতে পারে সফল উদ্যোক্তা। সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধিত করার পাশাপাশি প্রণোদনাও দিতে পারে।  

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র: শিক্ষক ও গবেষক      


https://samakal.com/opinion/article/263308/%E0%A6%87-%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BF