7/10/2024

ভূমিক্ষয় ও দূষণ : চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 


জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে প্রয়োজন পুকুর খনন বিভূতি ভূষণ মিত্র

 


উপ-সম্পাদকীয়

জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে প্রয়োজন পুকুর খনন

বিভূতি ভূষণ মিত্র
শনিবার, ০৬ জুলাই ২০২৪

প্রথমেই বিনয় মজুমদারের কবিতার কয়েকটি লাইন পড়ি আসুন-

এবং পুকুরটিও চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল, পুকুরের আনন্দ বেদনা/ পাতা হয়ে ফুল হয়ে ফুটে ওঠে পৃথিবীতে, এই বিশ্বলোকে।/ শাপলার ফুলে ফুলে পাতায় কখনো মিল থাকে, মিল কখনো থাকে না।

অথবা জসীম উদ্দীনের একটি কবিতা-

পুুরান পুকুর, তব তীরে বসি ভাবিয়া উদাস হই,/ খেজুরের গোড়ে বাঁধা ছোট ছোট ঘাট, করে জল থই থই;/ রাত না পোহাতে গাঁয়ের বধুরা কলসীর কলরবে,/ ঘুম হতে তোমা জাগাইয়া দিত প্রভাতের উৎসবে।

গাঁয়ের বধূদের কলসী নিয়ে পুকুরে যাওয়ার দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। বিনয় মজুমদারের এই চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল পুকুরেরও এখন দেখা মেলা ভার। ভূমি মন্ত্রণালয়ের

এক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের জলাভূমি গত ৫০ বছরে ৭০ ভাগ কমে গেছে। ১৯৭১

সালে জলাভূমির পরিমাণ ছিল ৯৩ লাখ হেক্টর। তা কমে এখন হয়েছে ২৮ লাখ হেক্টরে।

অর্থাৎ ৬৫ লাখ হেক্টর জলাভূমি কমেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের দিকে তাকালেও এমন চিত্র চোখে পড়বে। বিশ্বের মোট জলাভূমির প্রায় ৯০ শতাংশ বিলুপ্তি হয়েছে। বাকি জলাশয়গুলোও হুমকির মুখে রয়েছে। এইসব জলাভূমি মোট প্রাণী প্রজাতির ৪০ ভাগের আশ্রয় স্থল। প্রতিনিয়ত এসব জায়গা থেকে নতুন নতুন প্রজাতি আবিস্কৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিশাল বড় একটা প্রাণী প্রজাতি জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল। প্রায় ৬৪ প্রজাতির উভচর তো বটেই, ৮৩ প্রজাতির সৈকত পাখি, ৩০ প্রজাতির বুনোহাঁস, ৮ প্রজাতির শামুকখোল, ১৮ প্রজাতির বগলাসহ অসংখ্য প্রজাতির এর উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। এছাড়া প্রতি বছর শীতের সময় বিপুলসংখ্যক পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশে আসে যাদের আবাস স্থল ও খাবার দুটোই জলাভূমিকে কেন্দ্র করে।

নিশ্চিত অর্থেই এইসব প্রাণ বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এসব প্রাণ বৈচিত্রের বড় একটা অংশ পুকুরের জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল। এই পুকুরও এখন হারাতে বসেছে। মফস্বল শহরগুলোতে যাও পুকুর দেখা যায়, ঢাকা শহরে পুকুর এখন চোখে পড়ে না বললেই চলে। মৎস্য বিভাগের জরিপ অনুযায়ী ঢাকায় ১২০টি সরকারি পুকুর, ৩২টি বেসরকারি পুকুর এবং ৩১টি লেক আছে। অথচ ১৯৮৫ সালে এই পুকুরের সংখ্যা ছিল ২ হাজার। রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী পুরান ঢাকায় ১৯২৪ সালে ১২০টি পুকুর ছিল। এখন আছে মাত্র ২৪টি অর্থাৎ ৯৬টি পুকুরই ভরাট করা হয়েছে । তাদের মতে ঢাকায় ২৪১টি পুকুর কোনরকম টিকে আছে। পুরান ঢাকায় টিকে আছে ২৪টি। ২৪১টি পুকুর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মসজিদ-মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আওতায় আছে। যার ফলে সেসব কেউ দখল করতে পারে নাই। বাকি ৮৬টি পুকুরের ৭টি দখল করেছে সরকারি সংস্থা আর ৭৯টি দখল করেছে বেসরকারি সংস্থা। তাদের মতে, একটি শহর ৫ শতাংশ জলাশয় থাকার প্রয়োজন থাকলেও আছে মাত্র ২.৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স বা সংক্ষেপে বিআইপির তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে ঢাকা শহরে সবৃজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ছিল ৫৩.১১ বর্গ কিলোমিটার। ২০২৩ সালে তা কমে হয়েছে ২৯.৮৫ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯৫ সালে ঢাকায় জলাভূমি ও জলাধার ছিল ৩০.২৪ বর্গকিলোমিটার। জলাভূমি ভরাট হতে হতে এখন তা হয়েছে মাত্র ৪.২৮ বর্গকিলোমিটার।

জলাধার শুধু কমে যাওয়া নয় এখানকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে দিন দিন। বিশেষজ্ঞদের মতে যদিও একটি শহরে কমপক্ষে ১৫% জলাধার থাকা দরকার, কিন্তু বাস্তবে এখন তা ৪-৫% এরও কম। ২০১৮ সালে ঢাকায় ১০০টি পুকুর থাকলেও এটি এখন কমতে কমতে দাঁড়িয়েছে ২৯টিতে। ছয় বছরে পুকুর কমেছে ৭১টি। বিআইপির তথ্য মতে ২০১৯ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৩ হাজার ১৬২ একর জলাশয়ের মধ্যে ভরাট করা হয়েছে ২৭ শতাংশ। যার ফলে তাপমাত্র ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকায় ১৯৮৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি নাই হয়ে গেছে। তাদের মতে এভাবে চলতে থাকলে ২০৩১ সালের মধ্যে জলাভ’মির পরিমাণ ১০ ভাগেরও নিচে নেমে আসবে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী সেখানে খালের সংখ্যা ৪৭টি। রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের হিসাব মতে ঢাকায় ৫৬টি খাল খাকার কথা থাকলেও সবগুলোই প্রায় মৃত। যদিও ২৬ টি খাল উদ্ধারের পরিকল্পনা নিয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশন। শুধু ঢাকা নয় সারাদেশের চিত্র প্রায় একই রকম। বিভিন্ন পৌর এলাকাগুলোতে পুকুর ভরাট করে তোলা হচ্ছে বড় বড় ভবন। যেমন ২০২৩ সালে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় গত দুই বছরে ২০টি পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। এসব পুকুর ভরাট করে অধিকাংশই নির্মিত হয়েছে ভবন। অন্যান্য জেলাগুলোতেও এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে।

অর্থাৎ সমস্ত বাংলাদেশেই কমে যাচ্ছে পুকুরের সংখ্যা। যদিও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ অনুযায়ী প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার পরিবর্তন, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। এ আইন ভঙ্গ করলে ৫ বছরের কারাদ- অথবা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন; কিন্তু কে শোনে কার কথা। যে যার মতো করে পুকুর ভরাট করে চলেছে। এতে করে শুধু প্রাণ বৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব পড়ছে না, শহরজুড়ে বর্ষা এলেই দেখা যাচ্ছে জলাবদ্ধতা।

বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখ ৮৮ হাজার ২২২টি পুকুর রয়েছে। এসব পুকুরের গড় আয়তন ০.০১১ হেক্টর। এসবের মধ্যে ৪৬% পুকুরে চাষ করা হয়। বাকি পুকুরগুলোর কিছু চাষযোগ্য, কিছু পরিত্যক্ত। এসব পুকুরের একাধকি ব্যবহার রয়েছে। ৬৩% পুকুর হাত ধোয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। ২৫% পুকুর মাছ ধরার জন্য, ৭% সেচ দেবার জন্য এবং বাকি ৫% অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়। পুকুরের বহুবিধ ব্যবহার থাকলেও শহরে জনসংখ্যার চাপ বাড়তে থাকায় পুকুর ভরাট করে হয় সেসব জমি বিক্রি করে দিচ্ছে, নয়ত কেউ তা ভরাট করে ভবন তুলছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে একদিন হয়ত পুকুরই থাকবে না।

তাই সরকারের উচিত এসব জলাধার রক্ষায় এগিয়ে আসা। সরকার যত তাড়াতাড়ি এসব জলাধার রক্ষায় এগিয়ে আসবে, তত দেশের মঙ্গল। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ দেশ থাকবে। তা না হলে অসুস্থ দেশে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

পরিবেশ ও জলাধার সংরক্ষণ আইনের তোয়াক্কা না করেই পুকুর ভরাট করায় বেড়ে যাচ্ছে জলাবদ্ধতা। প্রতি বছর বর্ষার মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে শহর ও নগরের জীবন। এসব জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ পুকুর ভরাট করে অপরিকল্পিত নগরায়ন। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনের প্রয়োগ যেমন জরুরি তেমনি জরুরি পুকুর খনন করা।

[লেখক : শিক্ষক ও গবেষক]



https://sangbad.net.bd/opinion/post-editorial/2024/122068/

বিদেশি মাছে কী ক্ষতি

 বিদেশি মাছে কী ক্ষতি


ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৪, ১১:২৮

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্রকোনো একটি দেশের নদী তার মাছের জন্য পরিচিতি পায়। কানাডার দার্শনিক মাতশোনা ধলিওয়ায়ো বলেছিলেন এ কথা। বাংলাদেশের নদীগুলোর অসংখ্য দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে দেখে এটা মনে হলো। একটি তথ্যমতে, বাংলাদেশে বিদেশি মাছ আসা শুরু হয় ১৯৫২ সাল থেকে। ১৯৫২ সালে সিঙ্গাপুর থেকে সিয়ামিস গৌরামি মাছ, গোল্ডফিশ ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান, তেলাপিয়া ১৯৫৪, গুপ্পি ১৯৫৭ ও লাইলোটিকা ১৯৭৫ সালে থাইল্যান্ড, জাপান থেকে ১৯৭০ সালে গ্রাস কার্প ও সিলভার কার্প, মিরর কার্প ও ব্রিগেড কার্প নেপাল থেকে যথাক্রমে ১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালে, সরপুঁটি ও আফ্রিকান মাগুর থাইল্যান্ড থেকে ১৯৮৬ ও ১৯৮৯ সালে নিয়ে আসা হয়। সম্ভবত পিরানহা আনা হয় আমেরিকা থেকে।

পিরানহা, আফ্রিকান মাগুর বাংলাদেশে রাক্ষুসে মাছ নামে পরিচিত। এই মাছ বন্যার মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে দেশি জাতের অনেক মাছ খেয়ে ফেলে। এতে দেশি অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ২৬০ প্রজাতির স্বাদু ও ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ এদের কারণে হুমকির মুখে।

সাকার মাছ এতটাই বিষাক্ত যে এটি পোলট্রি ফিড তৈরিতেও ব্যবহার করা যায় না। এর বিস্তার ও বিভিন্ন জায়গায় বিক্রয় মানব শরীরে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি ঘটাতে পারে। সাকার মাছের বসবাস মূলত দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান অববাহিকায়। এটি সিলারিফর্মিস বর্গের লোরিকারিডাই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। সাকার ও আফ্রিকান মাগুর ৪ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এরা খুব দ্রুত বাড়ে। ওজন ১৫-১৬ কেজি হয়ে থাকে। পিরানহা মাছ সাধারণত ৬ ইঞ্চি থেকে দেড় ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এদের বসবাস মূলত দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকার জলাশয়ে। অনুকূল পরিবেশে এটি ৮ থেকে ১০ বছর বাঁচে। আফ্রিকান মাগুর সারা বিশ্বেই পাওয়া যায়।

সাকার মাছের কয়েক প্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশে দুই প্রজাতির সাকার মাছ প্রবেশ করেছে। একটি সাকার সাউথ ক্যাটফিশ, আরেকটি সেইলফিন ক্যাটফিশ। এই মাছের প্রজননকাল মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। একটি স্ত্রী সাকার মাছ ৫০০ থেকে ৩ হাজার ডিম পাড়ে।

এই মাছগুলো রাক্ষুসে প্রকৃতির হওয়ায় দেশীয় মাছের সঙ্গে খাবার নিয়ে প্রতিযোগিতা করে। দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু খেয়ে ফেলে। শেওলা ও অন্যান্য জৈব উপাদান খায় বলে খাদ্যশৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যায়। শুধু দেশীয় মাছের উৎপাদন ব্যাহত করে না, পুরো জীববৈচিত্র্যের ধ্বংসের কারণ হয়।

নিষিদ্ধ সাকার মাছ এখন সারা দেশেই নদ-নদী, খাল-বিলে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই পত্রপত্রিকা, ফেসবুকে এই মাছ নিয়ে নানা খবর চোখে পড়ে। এটি দ্রুত বিস্তার পাচ্ছে। কারণ, এটি অনেক প্রতিকূল পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে। এমনকি বুড়িগঙ্গায় যেখানে অক্সিজেন শূন্যের কোঠায়, সেখানেও এটি অনায়াসে বাঁচতে পারে। এটি অত্যন্ত বিষাক্ত মাছ, যেখানে ক্যাডমিয়াম পদার্থ পাওয়া গেছে। এই ক্যাডমিয়াম স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটি এতটাই বিষাক্ত যে এর পাখনা দ্বারা কোথাও ক্ষত হলে, সেখানে পচন ধরে। এমনকি অনেক মাছ এর খোঁচায় মারা যায়। এটি জলাশয়ের শেওলা ও প্লাঙ্কটন-জাতীয় খাবার খায়। এসব প্রাকৃতিক খাবারে ভাগ বসানোর কারণে দেশি মাছের খাদ্যসংকটে পড়তে হয়।

সাকার মাছ বাংলাদেশে আসে আশির দশকে। অনেকের মতে, এটি ব্রাজিল থেকে অ্যাকোরিয়াম মাছ হিসেবে বাংলাদেশে আসে। তবে মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, এটি অবৈধভাবে বাংলাদেশে এসেছে। পুষ্টিবিদদের মতে, এর শরীরে ভারী ধাতু, যেমন কপার, জিংক, লেড বা সিসা, ক্যাডমিয়াম ও ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এই মাছে ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ পাওয়া গেছে ১ দশমিক ৭ থেকে ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এটি মানবদেহের সহনশীল মাত্রার চেয়ে ১০০ গুণ বেশি। এ ছাড়া জিংক যে পরিমাণ পাওয়া গেছে, তা সহনশীল মাত্রার চেয়ে ৫০ গুণ বেশি। বিষাক্ত এই মাছ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ছাড়াও দেখা গেছে মফস্বলের নর্দমায়ও। ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এ মাছটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। সে অনুযায়ী মাছটি আমদানি, বংশবৃদ্ধি, পরিবহন, গ্রহণ, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পিরানহা এবং ২০১৪ সাল থেকে আফ্রিকান মাগুর মাছের চাষ, বংশবৃদ্ধি, বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া ‘মৎস্য সঙ্গ নিরোধ আইন ২০১৭’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। এই আইনে আফ্রিকান মাগুর ও পিরানহা মাছের রেণু, পোনা আমদানিতে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আর আইন অমান্য করলে দুই বছরের জেল ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে।

এই মাছগুলো নিষিদ্ধ হওয়ার পরও চাষ হচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চলে পিরানহা এমনকি ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, নারায়ণগঞ্জে আফ্রিকান মাগুরের চাষ হচ্ছে। উন্মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সেদিকে ব্যবস্থা নিতে হবে। মৎস্যচাষি, জেলে ও জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। হ্যাচারিতে প্রজনন, লালন-পালন বন্ধ করতে হবে। বিমান ও স্থলবন্দরে এসব মাছের আমদানি বন্ধে নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাকার, পিরানহা, আফ্রিকান মাগুর নিষিদ্ধ করা হলেও বিদেশি অনেক মাছই আগ্রাসী প্রকৃতির, যার কারণে স্থানীয় প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি ঘটছে। স্থানীয় জাতের মাছ হারিয়ে যাওয়ার আগেই এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। কেননা, ক্রমেই এসব রাক্ষুসে ও আগ্রাসী প্রকৃতির মাছের কারণে জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়ছে।

এই মাছগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তাই এগুলোর সম্পূর্ণরূপে নিধন জরুরি হয়ে পড়েছে। এসবের নিধন কার্যকর করতে হলে শুধু নিষিদ্ধ নয়, প্রয়োজনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়ে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ছাড়া অ্যাকোরিয়ামের মাছ আমদানির ব্যাপারে নীতিমালা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নজরদারিও। এসব মাছের বিস্তার নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। সঙ্গে প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


https://www.ajkerpatrika.com/345370/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%80-%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%A4%E0%A6%BF?fbclid=IwZXh0bgNhZW0CMTEAAR1Y2OKLpt5mPFgxdjZJPcZCA113rLmqQYF-lkZh2DVywnUTV4ooYAn8yJs_aem_yidg6xnkXdMyTlCwZUVImA

শান্তির বসবাস ফিরিয়ে দিতে পারে নগর-বন ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 



শান্তির বসবাস ফিরিয়ে দিতে পারে নগর-বন

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

নগর বা শহরের সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো জায়গায় যেকোনো ধরনের গাছ নিয়ে নগর-বন সৃষ্টি হয়। এটি হতে পারে রাস্তার দুই ধারে অথবা কোনো জলাশয়ের ধারে অথবা শহরের অন্য কোনো খালি জায়গায়। এর মাধ্যমে নগরে বা শহরে একটি সবুজ ঘন কাঠামো তৈরি হয়। নগরের বাস্তুতন্ত্রকে এটি বিস্তৃত ও সবুজ করে তোলে।

শহরের মানুষকে এটি নানাভাবে উপকারও করতে পারে। একটি ভালো ও বৈচিত্র্যময় নগর-বন শহরবাসীর নানা উপকারে আসে। নানা ধরনের নগর-বনের বনজ সম্পদ নানাভাবে মানুষকে উপকৃত করে। নগর-বন একটি ঘন সবুজ বনের কাঠামো দান করে।

এর মধ্যে ঘাস, ঘন ঝোপঝাড়ও রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা নগর-বনের গাছপালা শহরের মানুষের স্বাস্থ্যের নানা উপকারও করে। এটি যেমন তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, ঠিক তেমনি শব্দদূষণ, বন্যা ইত্যাদি থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে। এ ছাড়া বায়ুদূষণ কার্বনদূষণ প্রতিরোধে কাজ করতে পারে।এসব গাছের নানা রকমের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যমানও রয়েছে। 

নগর-বন নতুন কোনো ধারণা নয়। ১৯৯০ সালে কোরিয়ায় প্রথম নগর-বন ধারণাটি প্রতিষ্ঠা পায়। ২০১৩ সাল থেকে নগরকেন্দ্রিক বনায়ন আন্তর্জাতিকভাবে বন গবেষণায় একটি বড় ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে। সে সময় থেকেই জাতিসংঘ নগর বনায়নের গুরুত্ব তুলে ধরে এবং নগর পরিকল্পনায় এটি যোগ করার কথা বলে।

এমনকি ২০১৮ সালে নগর বনায়নের জন্য একটি বিশ্ব সংস্থা গঠিত হয়। সারা বিশ্বে তা গঠনের জন্য ঘোষণা দেওয়া হয়। সোসাইটি অব আমেরিকান ফরেস্টার্সের বন অভিধান অনুযায়ী, নগর বনায়নকে এমন একটি শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়, যেখানে শহর ও শহরের চারপাশে একটি বৃক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে। এমন একটি বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠবে, যা সমাজকে শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নান্দনিক  মূল্য দান করবে। নগর-বন বলতে শহর বা নগরের সব ধরনের সবুজ গাছপালা ও এর উপাদানকে বোঝাবে। নগরের বনজ সম্পকে নিয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা থাকবে। এ ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক ও অংশীদারের ভিত্তিতে নগরে বনায়ন করতে হবে, যা অর্থনীতি, পরিবেশ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটাবে।

নগরের মানুষের এখন একটি ভালো স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দরকার বেঁচে থাকার জন্য। বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ এমন এক পরিবেশে বসবাস করে, যেখানকার বাতাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রায় নেই। শুধু স্বাস্থ্যকর বাতাস পেলেই চলবে না, দরকার শীতল বাতাস। শহরে প্রচণ্ড মাত্রায় তাপ থাকে। বড় বড় দালানকোঠা থাকায় বায়ুপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। গাছপালা ছাড়া শহরের উত্তপ্ত হাওয়া আরো উত্তপ্ত হবে। এটি আরো দূষিত ও ক্ষতিকর হবে। এক যুক্তরাষ্ট্রে শহরে তাপপ্রবাহে প্রতিবছর এক হাজার ৩০০ মানুষ মারা যায় এবং সারা বিশ্বের হিসেবে এই সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরো বেশি হবে। নগরে থাকা একটি বড় ঘন গাছের স্তর প্রতিবছর ২২ পাউন্ড কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং এই পরিমাণ গাছের স্তর বছরে ছয় হাজার পাউন্ড অক্সিজেন তৈরি করে। এ ছাড়া এরূপ গাছপালা এক হাজার গ্যালন বৃষ্টির পানি শোষণ করতে পারে।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের তথ্য মতে, বিশ্বে দূষণের তালিকায় প্রায় শীর্ষে থাকে ঢাকা। ক্লিন এয়ার ফান্ডের তথ্য মতে, স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটি ফান্ডিং ২০২৩-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বায়ুর গুণগত মানোন্নয়নের তহবিলপ্রাপ্তিতে তৃতীয় ছিল বাংলাদেশ। এতে আরো বলা হয়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বায়ুর মানোন্নয়নে বায়লাদেশ ২.৪ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। আরো একটি তথ্য অনুযায়ী, শীতকালে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি এবং অস্বাস্থ্যকর হলেও বর্ষাকালে দূষণ একটু কম থাকে। বাংলাদেশের বায়ুদূষণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। দূষণ যেমন বাড়ছে, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ুদূষণজনিত নানা রোগ। মানুষের গড় আয়ুও কমে যাচ্ছে। একদিকে যেমন নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ ও জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে দ্রুত; অন্যদিকে বাড়ছে  শ্বাসকষ্ট। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এই বায়ুদূষণ যেটি বাড়ছে, সেটি আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকছে না। দূষণ হয়ে যাচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি। এর প্রভাব পড়ছে বেশি।

সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ঢাকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও বায়ুদূষণ রোধে নগর-বন তৈরির পরিকল্পনা করেছে। এই নগর-বন তৈরি করতে পারলে এটিই হবে ঢাকায় প্রথম পরিকল্পিত বন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, নগর বনায়নের জন্য দুটি স্থানও নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি বনানীতে এবং আরেকটি কল্যাণপুরে। জায়গাগুলো সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের। অধিদপ্তর সম্মতিও দিয়েছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, স্থানীয় জাতের গাছগুলো যেন নির্দারণ করা হয় রোপণের জন্য। শুধু স্থানীয় জাত হলেই হবে না, উদ্দেশ্যটাও লক্ষণীয়। কিছু জায়গায় নান্দনিক প্রয়োজনে গাছ লাগাতে হবে। সেই জায়গায় এক ধরনের গাছ আবার কিছু জায়গায় অর্থনৈতিক প্রয়োজনে গাছ লাগানো যেতে পারে, সেই জায়গায় স্থানীয় যেসব জাতের গাছ থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়, সেই সব গাছ লাগাতে হবে। এ জন্য অবশ্যই একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি রাখা যেতে পারে, যারা স্থানীয় কোনো জাতের গাছ কোথায় লাগাতে হবে, তা নির্ধারণ করে দেবে। তবে এ কথা অকপটে বলে দেওয়া যায়, এই নগর বনায়নের প্রচেষ্টা সফল হলে ঢাকার বায়ুদূষণ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হবে।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক


https://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2024/07/05/1403352?fbclid=IwZXh0bgNhZW0CMTEAAR1Z5KdzZZ_GawKrb2x4DpMzyENaoL_7Z7PszmOS9voT_8Pg0_m4WBhn8wM_aem_20Yw19ijLfwUUXnuUllUZQ


 

গাছের শত্রু-মিত্র ও বিদেশি প্রজাতি ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র



পরিবেশ-প্রতিবেশ

গাছের শত্রু-মিত্র ও বিদেশি প্রজাতি

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৪ ০৯:৫৩ এএম

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

‘অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান/ প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদি প্রাণ,/ ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা/ ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ-পরে; আনিলে বেদনা/ নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা বৃক্ষবন্দনার প্রথম দিকের কটি লাইন। শেষদিকটা এমন, ‘তব তেজে তেজীয়মান,/ সজ্জিত তোমার মাল্যে যে মানব, তারি দূত হয়ে/ ওগো মানবের বন্ধু, আজি এই কাব্য-অর্ঘ্য লয়ে/ শ্যামের বাঁশির তানে মুগ্ধ কবি আমি/ অর্পিলাম তোমায় প্রণামী’। 

 গুগল নিউজে প্রতিদিনের বাংলাদেশ”র খবর পড়তে ফলো করুন

পৃথিবীর একমাত্র অকৃত্রিম বন্ধু বোধ হয় গাছ। মানুষেরও বন্ধু। তবে গাছেদেরও টিকে থাকতে হয়। প্রতিযোগিতা হয়। এই প্রতিযোগিতায় কোনো গাছ টিকে থাকে। কেউ হারিয়ে যায়। পৃথিবীমাতার সন্তান হয়ে মানুষেরও দায়িত্ব নিতে হয়। মানুষ যেমন বৃক্ষ কর্তন করে, তেমনি বৃক্ষ রোপণও করতে হয়। প্রয়োজন হয় বনায়নের। বাংলাদেশে বনায়ন হয়। কিন্তু কখনও কখনও দেখা যায়, যে গাছ দিয়ে বনায়ন করা হয়Ñ সেই গাছই বনের জন্য শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। কেননা সেই গাছ এতটাই আগ্রাসী যে ওই গাছের কারণে দেশীয় প্রজাতির নানা ভেষজ ও প্রাকৃতিক গাছ বিলুপ্ত হয়ে যায়। দেশীয় গাছের বদলে জায়গা করে নিচ্ছে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণিসহ নানা জাতের বিদেশি গাছ। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি প্রভৃতি গাছের কারণে পশুপাখিদের খাদ্যশৃঙ্খলা ব্যাহত হয়। বন্য প্রাণীর জন্য তা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে। রোগবালাইয়ের কারণ হয়। এসব গাছের পানি শোষণ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় এর নিচে ঘাসজাতীয় গাছ হয় না। এতে করে বাস্তুতন্ত্রের একটি বড়সংখ্যক প্রজাতি বিলুপ্তির দিকে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

দেশি গাছ থাকলে সেখান থেকে ওষুধ তৈরি করা যাবে। পশুপাখি তাদের খাবার পাবে। বাস্তুসংস্থান ঠিক থাকবে। ভেষজ ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ওষুধ তৈরির কাঁচামাল খুঁজে পাবে সহজেই। এসব গাছ থাকলে পুষ্টিঘাটতি যেমন পূরণ হবে, তেমনি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার কাজগুলোও করা যাবে। মাটি, বাতাস সর্বোপরি পরিবেশ সুরক্ষিত থাকবে। বাংলাদেশে আশির দশকে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, পাইন এসব বিদেশি গাছ প্রবেশ করে। সে সময় এসব গাছের চারা বিনামূল্যেও বিতরণ করা হতো। পরে অবশ্য ২০০৮ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এর চারা উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। বন বিভাগও এর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।

এ দেশে ইউক্যালিপটাস জনপ্রিয় হওয়ার কারণ এটি দ্রুত বাড়ে। তেমন একটা যত্ন লাগে না। চারা রোপণ করলে ছাগল-গরু এসবের পাতা খায় না। চাষ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। এসব বিদেশি গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় জ্বালানিতে অবদান রাখলেও এর ফলে একটা পরিবেশের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে। এটি মাটি থেকে বেশি পরিমাণ পুষ্টি ও পানি শোষণ করায় এর আশপাশের স্থানীয় জাতের গাছ এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি গাছে কোনো পাখি বাসা বাঁধে না। এর নিচে যেমন বিশ্রাম নেওয়া যায় না, তেমনি এর কাণ্ড পাতায় কোনো অণুজীবও জন্মায় না। একটি বাস্তুতন্ত্রে প্রবেশকারী নতুন প্রজাতি এলিয়েন স্পেসিস বলে। এসব এলিয়েন স্পেসিসের কারণে স্থানীয় প্রজাতি ধ্বংসের মুখে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে কোনো প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণের মধ্যে একটি হলো সেই এলাকায় এলিয়েন স্পেসিস বা প্রজাতির প্রবেশ। যেসব প্রজাতি ভিন্ন বা নতুন বাস্তুতন্ত্রে প্রবেশ করে স্থানীয় প্রজাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তাদের আগ্রাসী এলিয়েন স্পেসিস বলে।

একটি গবেষণার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আর আহমেদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের এম কে হোসেনের গবেষণা। তারা দুজনে পরিবেশের ওপর ইউক্যালিপটাসের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পান ইউক্যালিপটাস লাগানোর ফলে মাটির উর্বরতা ১৫ শতাংশ কমে যায়। মাটির পানি দ্রুত শুষে নেয়। বাষ্পীভবনের হার বেশি এবং ৯২ ভাগ মানুষ এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবগত নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি গাছের সঙ্গে দেশি গাছ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। এমনিক এদের বংশ বৃদ্ধিও বন্ধ হয়ে যায়। উপকারী কীটপতঙ্গ মারা পড়ে। উত্তরাঞ্চলে হাটবাজারে বিক্রি হওয়া গাছের চারার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি। জমির আইলে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগালে ফসলে পানির অভাব হয়। একটি তথ্যমতে, ইথিওপিয়ায় ভুট্টাক্ষেতের পাশে ইউক্যালিপটাসগাছ লাগানোর ফলে হেক্টরপ্রতি ফলন ৪ দশমিক ৯ থেকে ১৩ দশমিক ৫ টন হ্রাস পায়। পাকিস্তানের একটি গ্রামে ১৯৯৫ সালে ইউক্যালিপটাসগাছ লাগানো হয়। ২০০০ সালে সেই গ্রামের পানির স্তর ২ ইঞ্চি কমে যায়। ইউক্যালিপটাসের ক্ষতি বুঝতে পেরে কেনিয়াতে এর রোপণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

বাংলাদেশে এলিয়েন প্রজাতি হিসেবে রয়েছে- কচুরিপানা, পার্থেনিয়াম, লজ্জাবতী, আসামলতা, স্বর্ণলতা, ঢোলকলমি। বাংলাদেশে এ রকম ১৫টি আগ্রাসী এলিয়েন স্পেসিস শনাক্ত করেছে ন্যাশনাল বায়োডাইভারসিটি স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান। এলিয়েন স্পেসিসকে আগ্রাসী ও ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করা হয়েছে ন্যাশনাল বায়োডাইভারসিটি স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যানে। বিদেশি গাছ এখানে নানাভাবে প্রবেশ করেছে। তবে অধিকাংশ প্রজাতি মানুষের মাধ্যমেই ছড়িয়েছে। রেইনট্রি, সেগুন, আকাশমণি, আকাশি, শিশু, বাবলা, ইউক্যালিপটাস এসব নানা জাতের বিদেশি গাছের আশ্রয় এখন বাংলাদেশ। বাংলাদেশে রেইনট্রি, মেহগনি, চাম্বল প্রভৃতি গাছ প্রবেশ করে ব্রিটিশ আমলে। আকাশমণি, শিশু, ইপিলইপিল, বাবলা, ইউক্যালিপটাস এবং খয়েরজাতীয় গাছ প্রবেশ করে আশির দশকে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রবেশ করেছে কচুরিপানা, পার্থোনিয়াম, স্বর্ণলতা, মটমটিয়া, রিফুজিলতা ইত্যাদি। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব বিদেশি গাছের কারণে বাংলাদেশে ৫ হাজার প্রজাতির দেশি গাছ থাকলেও এটি এখন কমে ৩ হাজার ৮২৮ প্রজাতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এই ক্ষেত্রে বিদেশি গাছ আমদানি করতে একটা নীতিমালা দরকার। কোন গাছ আনা যাবে, আর কোনটি আনা যাবে না, তা বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। ক্ষতিকর বিদেশি গাছ শনাক্ত করে সারা দেশে তা কর্তনের ব্যবস্থা করতে হবে। বন বিভাগকে বিদেশি জাতের উদ্ভিদ না দিয়ে দেশি জাতের চারা বিতরণ করতে হবে। তাহলেই হারিয়ে যাওয়া প্রজাতি হয়তো আবার দেখা দেবে। পশুপাখিরা পাবে তাদের খাবার আর আশ্রয়স্থল।