কতটা উন্নত সুন্দরবনের পরিবেশ
ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
খুব বেশিদিন আগে নয়, ২০২৩ সাল অর্থাৎ গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশের বাঘ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বাঘ পাচারে বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষ দেশ। বাঘ নিয়ে গবেষণা করে প্যানথেরা নামের একটি সংগঠন এবং চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেস এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্দরবনে শিকার হওয়া বাঘের বিভিন্ন অংশ বিশ্বের ১৫টি দেশে পাচার করা হয়, যদিও সরকার দাবি করে আসছে যে বাঘ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তারা যথাযথ ব্যবস্থা রেখেছে।
যা হোক, এই প্রতিবেদনটি যে কাউকে চমকে দেওয়ার মতো।
বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবনের বাঘ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে ২০১৬ সালে। শোনা যায়, অভিযান শুরুর পর অন্তত ১১৭ জন পাচারকারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কয়েক শ জন গ্রেপ্তার হয়েছে।
অনেকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় এসেছে। অভিযানের আগে পাচারকারীদের এই ব্যবসা ছিল রমরমা। গবেষণায় বলা হয়, আন্তর্জাতিক চক্র ছাড়াও দেশের ভেতরেও বাঘের বিভিন্ন অংশের চাহিদা আছে বলে উল্লেখ করা হয়, যদিও বন বিভাগ বলেছে গবেষণার এই বিষয়টি বিতর্কিত। গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের সুন্দরবন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর মায়ানমার অঞ্চলে বাঘ শিকার ও চোরাচালান হয়।
কনজারভেশন সায়েন্স ও প্র্যাকটিস জার্নালে এই প্রতিবদেনটি প্রকাশিত হয়। এতে বাংলাদেশের বাইরে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কোথায় কোথায় যায়, তা-ও চিহ্নিত করা হয়েছে। বাঘের এসব অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গের চাহিদা রয়েছে ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো দেশে। ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের চ্যানেলগুলো নিয়ন্ত্রণ করত প্রায় ৩০টি জলদস্যু দল। তাদের মধ্যে সাতটি জলদস্যু দল প্রত্যক্ষভাবে বাঘ শিকার করে এবং বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চোরাচালানে নেতৃত্ব দেয়।
গবেষকদলটি স্থল, সমুদ্র এবং আকাশপথে বাঘ পাচারের সঙ্গে জড়িত ১৬৩ জন চোরাকারবারি ও ব্যবসায়ীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এতে তারা বাঘ শিকারের চারটি উৎসস্থল চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো—ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন, ভারতের কাজিরাঙ্গা-গরমপানি পার্ক, মায়ানমারের নর্দার্ন ফরেস্ট কমপ্লেক্স ও ভারতের নামদাফা-রয়াল মানস পার্ক।
একটি তথ্য মতে, সুন্দরবনে প্রথম বাঘ জরিপ হয় ২০১৩-১৪ সালে। সে সময় বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬। এক দশকে বাঘ কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ। ২০০৪ সালে ছিল ৪৪০টি। তবে এই সংখ্যাটি বাংলাদেশ ও ভারত দুই অংশের সুন্দরবন মিলিয়ে। ২০১৮ সালে বাঘশুমারিতে পাওয়া গিয়েছিল ১১৪টি। একটি তথ্য মতে, ২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে কমপক্ষে ৪৬টি বাঘ মারা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাঘের বিচরণক্ষেত্র ও বাংলাদেশে সুন্দরবনের মোট এলাকার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০ থেকে ২৫০টি বাঘ থাকা দরকার। একসময় বেশির ভাগ দেশে বাঘ পাওয়া যেত। এখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের মোট ১৩টি দেশে একে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে গত ১০০ বছরে বাঘের সংখ্যা ৯৫ শতাংশ কমলেও এর সংখ্যা এখন বাড়ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে বাঘ জরিপের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৯.৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাঘের সংখ্যা হয়েছে এখন ১২৫। বাংলাদেশে বাঘের অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় হুমকি চোরা শিকার। চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্যও অনেকটা থামানো গেছে। সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করলে শিকার একেবারেই কমে যাবে। এ ছাড়া পাচার ঠেকাতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। ফাঁদ পেতে, বিষটোপ দিয়ে বাঘ শিকার করা হয়। এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, কোস্ট গার্ড ও বন বিভাগের সমন্বয়ে দক্ষ টিম থাকতে পারে সুন্দরবনে। বাঘ শিকারি বা হত্যাকারীর শাস্তি সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ সাত বছর এবং জরিমানা এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা। দোষীদের শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। জাতিসংঘের মতেও সুন্দরবনে বাঘ কমে যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ চোরাকারবারি। সে ক্ষেত্রে সুন্দরবনের পরিবেশ সংরক্ষণের পাশাপাশি চোরাকারবারিদের ঠেকাতে পারলে বাঘের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে অনেকেই মনে করেন।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
https://www.kalerkantho.com/online/miscellaneous/2024/10/20/1437100
No comments:
Post a Comment