আলোকদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব

 

আলোকদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:২২ পিএম
2Shares
facebook sharing button
messenger sharing button
sharethis sharing button
আলোকদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব
ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র


আলোকদূষণ বলতে বোঝায় এক ধরনের কৃত্রিম আলো, যা অবাঞ্ছিত ও অনুপযুক্ত। আলোকদূষণ দিনে বা রাতেও হতে পারে। এটি আলোর নেতিবাচক প্রভাব, রাতে মূলত এর দূষণ বৃদ্ধি পায়। এটি মানবসৃষ্ট অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত আলো। আলোকদূষণ দুভাবে হতে পারে। সরাসরি কোনো উৎস থেকে আলো এসে দূষিত করতে পারে। এ ছাড়া দিগন্তের আকাশকে আলোকিত করার মাধ্যমেও আলোকদূষণ হতে পারে।  

একটি তথ্যমতে, বিশ্বের ৮৩ ভাগ মানুষ আলোকদূষণের শিকার। দিন দিন কৃত্রিম আলো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে আলোকদূষণের এলাকা। অর্থাৎ নগরায়ণ যত বাড়ছে আলোকদূষণ ততটাই বাড়ছে। এটি স্বাস্থ্য, বাস্তুতন্ত্র আর নান্দনিক পরিবেশকে নষ্ট করে দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ৯৯ ভাগ মানুষ প্রাকৃতিক রাত দেখতে পায় না। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, আলোকদূষণ শহরাঞ্চলে বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আলোকদূষণ বেড়েছে প্রায় ৪৯ শতাংশ। কৃত্রিম আলোর অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের কারণে মূলত আলোকদূষণ হয়। অতিরিক্ত আলোর প্রবেশ, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা, আলোক বিশৃঙ্খলা আলোকদূষণের কারণ। এটি যেহেতু মানবসৃষ্ট, তাই আলোকদূষণকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। কৃত্রিম আলোর কারণে মানুষ তো বটেই, ক্ষতির মুখে পড়ছে জীবজগৎও।

 বিশ্বের ৮০ ভাগ মানুষ দূষিত আলোয় বসবাস করে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আলোকদূষণ ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে। কৃত্রিম আলোকদূষণের একটি বড় উদাহরণ হতে পারে সিঙ্গাপুর। এ দেশটি রাতের বেলা এত উজ্জ্বল থাকে যে, এখানকার মানুষ সত্যিকার অন্ধকারে চোখ মেলে তাকাতে পারে না। আবার সত্যিকার আলোতেও তাকাতে পারে না। শহরগুলোতে বিলবোর্ড, ফ্লাডলাইট, স্ট্রিটল্যাম্পের মাধ্যমে আলোকদূষণ ঘটছে। 

এসব আলোর ঝলকানিতে মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে। এর ফলে চোখের ক্ষতি যেমন হচ্ছে, তেমনি নিদ্রাহীনতা, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, হৃদরোগ, ক্যানসার এমনকি ডিপ্রেশনও বেড়ে চলেছে। আলঝাইমার রোগের জন্যও আলোকদূষণকে দায়ী করা হয়। স্তন ও প্রোস্টেট ক্যানসারও হয়। এ ছাড়া এর কারণে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে। হাসপাতাল এলাকায় অতিরিক্ত আলোয় রোগীদের অসুবিধা হয়। আলোকদূষণ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণও বেড়ে যায়। 
 
মানুষের ওপর এসব ক্ষতিকর প্রভাব ছাড়াও জীববৈচিত্র্যের ওপরও প্রভাব বাড়ছে। তারা দিন ও রাত পার্থক্য করতে পারছে না। ফলে জীববৈচিত্র্যের ওপর একটি ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলছে কীটপতঙ্গের ওপর। একটি গবেষণা তথ্য মতে, জার্মানিতে প্রতি গ্রীষ্মে কৃত্রিম আলোর কারণে ১০০ বিলিয়নেরও বেশি কীটপতঙ্গ মারা যায়। কীটপতঙ্গ সাধারণত চাঁদের আলোর ওপর নির্ভর করে চলাচল করে। বিলবোর্ডের আলো, রাস্তার ল্যাম্পের আলোয় এরা পথ ভুলে যায়। কৃত্রিম আলোর চারপাশে জমা হতে থাকে। এক সময় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অনেক কীটপতঙ্গ মারা যায়। শুধু তাই নয়, এ সময় এরা শিকারি বা অন্য প্রাণীদের হাতে মারা পড়ে। 

এ ধরনের কীটপতঙ্গের গর্ভধারণ ক্ষমতাও কমে যায়। নিশাচর প্রাণী, যেমন- বাদুড় ইত্যাদির ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। পরিযায়ী পাখিরাও এর কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। একটি তথ্য মতে, এসব আলোকদূষণের কারণে দুই-তৃতীয়াংশ উদ্ভিদের পরাগায়ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃত্রিম আলোর কারণে শুধু মানুষ নয়, পশুপাখি, উদ্ভিদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, যেসব গাছ রাস্তার পাশে ল্যাম্পের কাছাকাছি থাকে, সেসব গাছের ফল ধারণক্ষমতা কমে যায়। এর কারণে শ্যাওলাজাতীয় গাছের ক্ষতি হয়। এটি পানি বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। পানির গুণাগুণ নষ্ট করে দেয়। যেসব প্রাণী রাতে শিকার করে, তাদের খাদ্যাভ্যাসের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। 

একটি তথ্য মতে, বিশ্বের ৩১৭ মিলিয়ন রাস্তার আলো ২০২৭ সালে বেড়ে ৩৬৩ মিলিয়ন হবে। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে প্রতি বছর কৃত্রিম আলোর বিস্তৃতি বেড়েছে ২ শতাংশ। এর ফলে কার্বন নির্গমন যেমন বাড়বে তেমনি পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বেড়ে যাবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলসি কলেজের সহকারী অধ্যাপক লামিরা মওলা জানান, ঢাকা কৃত্রিম আলোকদূষণে পঞ্চম। এখানে প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে উজ্জ্বলতার বিস্তৃতি ঘটছে। এর ফলে ক্ষতির মুখে পড়ছে এখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণী। জীবনচক্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জৈবিক দেহঘড়ির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। আলোকদূষণের ফলে বংশবৃদ্ধিতে যেমন ব্যাঘাত ঘটছে, তেমনি স্বাভাবিক জীবনযাপন, যেমন ঘুম প্রভৃতিতেও ব্যাঘাত ঘটছে। 

২০০৩ সালে বাংলাদেশের মাত্র ৭ দশমিক ৩ শতাংশ এলাকায় আলোকদূষণ হতো। এই দূষণ বেড়ে এখন হয়েছে ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আলোকদূষণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে ঢাকায়, এর পর রয়েছে চট্টগ্রাম, তার পর খুলনা, সিলেট, রাজশাহী। বাংলাদেশ জাতীয় পরিবেশনীতি ২০১৮-তে আলোকদূষণ রোধের কথা বলা থাকলেও, আমরা তা নিয়ে ততটা ভাবছি না। 

এ ক্ষেত্রে আমরা চাইলেই অনেক আলোকদূষণ কমিয়ে আনতে পারি। যেমন- আলোক তীব্রতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসা, শুধু প্রয়োজনীয় স্থানে আলো ব্যবহার করা, কমলা রঙের আলো ব্যবহার করা ইত্যাদি। বাসাবাড়িতে আমরা যেসব বাল্ব ব্যবহার করি, সে ক্ষেত্রে বাসাবাড়ির ভেতরে ৭৪ থেকে ২১০ ওয়াটের মধ্যে, আর ভবনের বাইরে ৪৯ থেকে ৯১ ওয়াটের মধ্যে বাল্ব ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া যত্রতত্র নিয়ম না মেনে সড়কে বাতি স্থাপন করা, বাড়ির ভেতরে ও বাইরে অতিরিক্ত বাতি ব্যবহার, যত্রতত্র বিলবোর্ডের ব্যবহার রোধ করতে হবে।     

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

মন্তব্যসমূহ