9/28/2024

প্লাস্টিকের পৃথিবী ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

 


প্লাস্টিকের পৃথিবী

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০৯:০৮

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র২০২৩ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে স্লোগান ছিল—‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিকদূষণ’। আমরা পণ করেছি, পণ করার পর কি পণের কথাটি মনে রেখেছি? প্লাস্টিক আবিষ্কৃত হয় ১৯০৭ সালে। বিজ্ঞানী বেকল্যান্ড এটি আবিষ্কার করেন। এটি পেট্রোলিয়াম দিয়ে তৈরি একটি যৌগ। বেকল্যান্ড এটি আবিষ্কার করার সময় কি ভেবেছিলেন, এর ব্যবহার এতটাই হবে যে একদিন পুরো পৃথিবীটাই প্লাস্টিকে ঢেকে যাবে। 

বিশ্বে প্রতিবছর প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয় প্রায় ৪৫ কোটি টন। প্লাস্টিক বর্জ্য ৪০০ বছর পর্যন্ত পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব রাখতে পারে। প্লাস্টিকদূষণকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। প্লাস্টিক এখন সাগরের তলদেশ থেকে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি হয় প্রায় ৫ লাখ। বিশ্বে বছরে ৮০ লাখ টন বর্জ্য সাগরে মিশে যায়। একটি গবেষণার তথ্যমতে, দোকানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ২০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। কোমল পানীয়তে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর বোতল হিসেবে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ৪৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। 

বাংলাদেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির বাজার ১ বিলিয়ন ডলারের মতো। প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। ঢাকায় প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখ পলিব্যাগের বর্জ্য ফেলা হয়।

প্লাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছেই। বাংলাদেশে ২০০৫ সালের বার্ষিক মাথাপিছু ব্যবহার ছিল ৩ কেজি। এটি বেড়ে ২০২০ সালে হয়েছে ৯ কেজি। অর্থাৎ ১৫ বছরে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে ৩ গুণ। বাংলাদেশে প্রতিদিন ৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ঢাকায় প্রতিদিন ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। ঢাকার মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের ৬০ শতাংশ মেশে রাস্তাঘাট আর নদীতে। মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, আমাদের দেশে প্রতিবছর ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য হয়। এর মাত্র ৪০ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়। অর্থাৎ ২ লাখ ২৮ হাজার টন পুনরায় ব্যবহৃত হয় আর বাকি অংশ পরিবেশেই থেকে যায়। 

সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ কলের জলে মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। যেখান থেকে প্রতি মাসে ২১ গ্রাম এবং বছরে ২৫০ গ্রাম এই প্লাস্টিক মানুষের শরীরে ঢুকে গুরুতর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিকের বর্জ্য মাইক্রো ও ন্যানো কণা রূপে মানুষের শরীরে ঢুকে হরমোনজনিত নানা সমস্যা সৃষ্টি করছে। এটি মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুক্রাণু ও ডিম্বাণু উৎপাদন ব্যাহত করছে। ক্যানসারসহ ত্বকের নানা রকম রোগ সৃষ্টি করছে। 

ফথেলেটস, বিসফেনোন, অর্গানোটিনস, পার ও পরি ফ্লোরোঅ্যালকাইল, বিসফেনল এ প্রভৃতি রাসায়নিক উপাদান প্লাস্টিকে থাকে, যা স্থূলতা, গর্ভধারণের ক্ষমতা হ্রাস, বিভিন্ন স্নায়ুরোগ ঘটাতে পারে। প্লাস্টিক জনস্বাস্থ্যের জন্যই হুমকি নয় শুধু, এটি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করছে। প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব এবং এর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে জানলেও আমরা কিন্তু ঘুম থেকে উঠে আবার রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত প্লাস্টিকই ব্যবহার করে থাকি। 

যদিও বাংলাদেশই বিশ্বে প্রথম প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে ২০০২ সালে। ২০১০ সালে প্লাস্টিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ন্যাশনাল থ্রি আর নীতি চালু করে। ন্যাশনাল থ্রি আর অর্থ হলো রিডিউস, রিইউজ ও রিসাইকেল। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার জুট প্যাকেজিং আইন পাস করে। 

তা সত্ত্বেও আমরা ক্রমাগত একটি প্লাস্টিকের পৃথিবীর দিকে এগোচ্ছি। এর পরিণাম জানার পরও সচেতন হচ্ছি না। এ জন্য প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহার নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কঠোর হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে পলিথিন ব্যাগ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে সোনালি ব্যাগ বাজারজাতকরণে কর্তৃপক্ষের এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

No comments:

Post a Comment